তাসনিম আলম কাব্য
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:১৭ পিএম
অলঙ্করণ : জয়ন্ত জন
হিজল গাছের সাথে আমার সখ্যতা অনেক পুরনো। আমাদের বাড়ির পুকুরপাড়েই বিশাল বড় একটা হিজল গাছ আছে। পুকুরের উপর অনেক জায়গা নিয়ে ছায়া দিচ্ছে বহুবছর হলো। আমি স্কুল শেষ করে এসেই, গাছটার কাছে চলে যেতাম। মুগ্ধ হয়ে ফুলগুলো দেখতে দেখতে বহু সময় কেটে যেতো। হিজলের সবুজ ফলগুলো দিয়ে আব্বা আমাদের সাঁতার শেখাতেন। ফল পানির ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে আব্বা সাঁতরে নিয়ে আসতে বলতেন। প্রথমে কাছাকাছি তারপর আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়াতেন। এভাবেই সাঁতার শিখেছি।
স্কুলে ভর্তি হবার পর দিনগুলো মজার ছিলো। আম্মা সরিষার তেল আমার মাথায় দিয়ে খানিকবাদেই গোসল করিয়ে দিতেন। তারপর খাইয়েদাইয়ে পরিপাটি করে দিতেন স্কুলে যাবার জন্য। আর কপালের বাম পাশে আম্মা কাজল দিতে দিতে বলতেন "আব্বু তোমারে একটা চোখ বানায় দিলাম। এইটা হইলো আমার চোখ। যাতে তোমার নজর না লাগে, তুলে ফেলবা না কিন্তু।"
আমি চোখ কপালের দিকে নিয়ে আম্মার এঁকে দেওয়া চোখ দেখার চেষ্টা করতাম। চুল আঁচড়ে, আমি পায়ে স্যান্ডেল পরে স্কুলে যেতাম। পুরো স্কুলে হাতেগোণা দু'চার জন স্যান্ডেল পরে স্কুলে আসতো। বাকীরা খালি পায়ে। আব্বা ফরিদপুর শহর থেকে আমার জন্য ছোট্ট একটা ব্যাগ আর তিনটা বই নিয়ে এসেছিলেন। দুটো গল্প আর কবিতার বই আর অন্যটা স্বরলিপির বই। আমি এই স্বরলিপির বইটাকেই ভয় পেতাম। কতবার যে খাটের নিচে লুকিয়েছি কিন্তু আম্মা জানতেন আমি কোথায় রাখি। ঠিক বের করে আমার সামনে হাজির করতেন। আমার মনে হতো স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের মাঝে যুদ্ধ হচ্ছে আর আমি যেন সে যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে গেছি। এই স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের যুদ্ধ থেকে বাঁচতাম স্কুলে গিয়ে। স্কুলে তৃতীয় স্যার নামে একজন স্যার ছিলো। সবাই এ নামেই ডাকতাম। খুব মজা করতো আমাদের সাথে। পুরো স্কুলের প্রিয় স্যার ছিলো সে।
স্কুলে গিয়ে কয়েকজনের সাথে আমার খুব দোস্তি হয়। আমার জন্য প্রতিদিন ২ টাকা বরাদ্দ ছিলো। সে সময়ে ২ টাকায় বাড়িতে ভাজা চিপস, আচার, ২৫ পয়সায় নাবিস্কো চকলেট, ২ টাকায় সকাল-সন্ধ্যা আইসক্রিমসহ আরো বহুকিছু পাওয়া যেতো। আইসক্রিমকে আমার বলতাম মালাই, মালাইয়ের কাঠি থাকতো বাঁশের। আমরা সে বাঁশের কাঠি জমাতাম। কেন জমাতাম সে গল্প অন্যদিন বলবো । তো আমি কিছু কিনলে তাদের ছাড়া খেতাম না।
একদিন টিফিন টাইমে আমরা গোল্লাছুট খেলছিলাম। আমার বন্ধু জামিল দৌড় দেওয়ার সময় একটা মেয়ে পা বাড়িয়ে ল্যাং দিয়ে ওকে ফেলে দেয়। আমি প্রচন্ড রাগে আমার স্লেট দিয়ে মেয়েটার মাথায় মেরে দেই। মেরেই ভয় পেয়ে দৌড়ে স্কুলের পাশে কাঁঠাল বাগানে চলে যাই। খানিকবাদে স্কুলের অফিসে আমার ডাক পরে। আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখি, মেয়েটার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হচ্ছে। হেড স্যার আমার বাবার নাম জানতে চাইলো। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলো- কেন মেরেছিস? আমি কারণ বললাম। স্যার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমায় ছেড়ে দিলেন। রাতে আব্বার মুখে শুনেছি ঐ মেয়েটা ছিল হেড স্যারেরই ছোট মেয়ে। আব্বা আমায় আর গ্রামের বাড়িতে রাখতে চাইলেন না। তার মাসখানিক পর আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসলাম দাদীর সাথে, ছোট চাচার বাসায়। বছরখানেক আগে হেডস্যারের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। খোঁজখবর আর আলাপচারিতার ফাঁকে স্যার ওনার মেয়ের মাথা ফাটানোর গল্পটা আমায় বললেন। তারপর স্যার খানিকটা হেসে বললেন, " হৈমন্তী (স্যারের ছোট মেয়ে) নাকি এখনো অপেক্ষা করছে, যে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলো তার মাথা ফাটানোর জন্য "
আমি মুগ্ধ হয়ে স্যারের হাসি দেখছিলাম। অদ্ভুত শুভ্র সে হাসি, শিক্ষক হওয়ার অদ্ভূত আর অবর্ণনীয় একটা তৃপ্তি তার চোখে-মুখে খেলা করছিলো। আর আমি শৈশবের স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলাম।