রাতুল মুন্সী
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৩১ পিএম
১৯৫৫ সাল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে ছাত্রদের ‘শহীদ দিবস’ পালন করতে দেবে না তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। সারা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা। রাস্তায় স্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ। মিছিল, শোভাযাত্রা সবই নিষিদ্ধ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ভাষা আন্দোলনে ভাই হারানোর বেদনা রাস্তায় মিশে থাকা রক্তের দাগ ভোলেনি। প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আসা স্বজন হারানোর আহাজারি এখনও কানে বাজে তাদের।
মনে হলে গা শিয়রে ওঠে। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার কোন জায়গাটায় জানি তাদের ভাইয়ের রক্ত মিশে আছে। ফাল্গুন এলেই বাতাসে গাছের পাতা ঝরার মর্মর শব্দের সঙ্গে শহীদদের স্লোগান শুনতে পান অনেকেই।
কেউ ঘরে থাকতে পারে না। রাতে হঠাৎ যখন ঘুম ভাঙে, দেখা যায় ঘামে ভিজে আছে শরীর। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তারা আমার ভাই, তারা আমার আপনজন। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের সাহস জুগিয়েছে আরও বেশি। শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে কিছু করতে হবে।
জহির রায়হানের উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। পরবর্তী ১৯৫৫ সালে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর উদ্যোগ, সাহস, বিদ্রোহ, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার ঘটে যাওয়া কতগুলো ছোট ছোট ঘটনা। উপন্যাসে প্রেম আছে, দ্রোহ আছে, প্রিয় মানুষটাকে না পাওয়ার ব্যথা আছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে ফিরে পাওয়াসহ উচ্চবিত্ত এবং বাংলা ভাষাবিরোধী কিছু মানুষের জীবনযাপন তুলে ধরেছেন লেখক।
সরকারি বাধাকে উপেক্ষা করে অন্যায়কে প্রতিহত করার বলিষ্ঠ দৃঢ়ভঙ্গিকে কেন্দ্র করে জহির রায়হান রচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন।’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে।
ফাল্গুন এলেই প্রিয়জনকে নিয়ে লেখা চিঠির শেষ লাইনে আমরা বলিÑ ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো।’ উপন্যাসের শেষের দুই লাইনে এই কথা জোর গলায় বলছিল এক যুবক। তার কথায় আছে প্রেম এবং আছে দ্রোহ। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার ভবিষ্যদ্বাণী আমরা খুঁজে পাই। প্রতিবাদ এখনও থেমে যায়নি। এখান থেকে প্রতিবাদ আবার শুরু।
উপন্যাসের নায়ক মুনিম চেয়েছিল ডলি রাজপথের সঙ্গী হোক। শেষ পর্যন্ত ডলি এসেছিল ফুল হাতে। উপন্যাসের কিছুটা সার্থকতা জহির রায়হান এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে ডলি আন্দোলনের সময় মুনিমকে ছেড়ে গিয়েছিল, সেই ডলিই আবার গ্রেপ্তর হওয়া মুনিমের হাতে ফুল তুলে দিয়েছিল।
একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি চলছে। স্বৈরাচারী সরকারের সব বাধাকে উপেক্ষা করে শহীদ দিবসকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে মুনিমের মতো আসাদ, সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল দিন-রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, স্লোগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সবাই অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত এবং সক্রিয়। সবাই শপথ করে তিন দিন নগ্ন পায়ে হাঁটবে, শহীদদের স্মরণে রোজা রাখবে, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন কালো পতাকা উত্তোলন করে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবে।
মুনিমের সঙ্গে আরেকজন আপসহীন একনিষ্ঠ কর্মী আসাদ। কোনো প্রতিকূলতাই তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। কোনো কাজে তার ক্লান্তি নেই। বাড়ি ফেরারও তাড়া নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর যখন জেলে পাঠানো হচ্ছিলÑ সবার জন্য কেউ না কেউ এসেছিল। আসাদের কেউ আসেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ বলেছিলÑ আমার তো মা নেই, কে আসবে?
উপন্যাসে কয়েকটা চরিত্র আছে, যারা সমাজে উচ্চবিত্ত, পুলিশ অফিসার, একজন কবি, হলের দায়িত্বে থাকা প্রক্টর। যাদের দেশ, মায়ের ভাষা এবং শহীদদের শ্রদ্ধার প্রতি উদাসীনতা এবং সরকারের হুকুমের গোলামির দৃশ্যটা ফুটে উঠেছে। এদের একজন কবির ভাষ্য এমন ছিল- ‘আমরা হলাম সাহিত্যিক। সমাজের আর দশটা লোক মিছিল আর শোভাযাত্রা বের করে পুলিশের লাঠি খেয়ে প্রাণ দিলে কিছু এসে-যায় না। কিন্তু আমাদের মৃত্যু মানে দেশের এক একটি প্রতিভার মৃত্যু।’
সেই কবি ভুলে গিয়েছিল বাংলা তার মায়ের ভাষা, যে ভাষায় প্রথম সে মা বলে ডেকেছিল। কিন্তু সেই ভাষা কেড়ে নিচ্ছে একটা গোষ্ঠী।
আর এভাবেই ১৯৫৫ সালে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল- তাদের ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মাতৃভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, দৃঢ় অঙ্গীকার, মাথা নত না করার প্রত্যয় বলে দেয়, এই মিছিল আরও দীর্ঘ হবে আরও লাশ পড়বে। তবুও আমরা মাথা নত করব না। এই প্রেম এবং দ্রোহ একদিনের নয়, বহুদিনের।