রেজাউল আলম
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৫ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৬ এএম
ছবি : আলী হোসাইন মিন্টু
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ধারণ এবং লালন করে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা এক ছাত্র আমি। জীবনের প্রথম চাকরির আবেদনটা বাংলায় করব বলে খুব শখ। কিন্তু বাংলায় দরখাস্ত করা হলো না। এখনকার খুব কম অফিসই চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে বাংলায় জীবনবৃত্তান্ত জমা নেয়। আর বাংলায় যারা আবেদন করে, তারা সম্ভবত প্রথমেই বাদ পড়ে। এটা শিক্ষাজীবনের বড় অযোগ্যতা। কারণ সে বাংলায় জীবনবৃত্তান্ত পাঠিয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল কি, আর হলো কী?
এর জন্যই কি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন? মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই, সংগ্রাম। তাহলে কি বায়ান্ন থেকে একাত্তর, ভুলে গেছি আমরা? নাকি ভুল চর্চা করতে করতে ভুলে যেতে বসেছি। যে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাষা আন্দোলন। সে দেশে নিজের ভাষা, মায়ের ভাষা, কেন ঘরের কোণে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সঠিক পরিচর্যার অভাবে? এ প্রশ্নই থেকেই যায়।
যাদের আত্মত্যাগে আমরা মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারছি, স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। সেই স্বীকৃতি কতটুকু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি আমাদের মনে, মগজে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি এখনও। এই ব্যর্থতা কার? অফিস-আদালতে বাংলা ভাষায় কথা বলতে গেলে অনেক সময় লজ্জায় পড়তে হয়, এই বুঝি মান-সম্মান সব গেল। অথচ ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলার সূর্যসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের ডাকা গণপরিষদে গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন- পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি এবং উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার প্রস্তাব রাখছি। গণপরিষদের সভায় তার স্পষ্ট কথা ছিল, দেশের ৬ কোটি ৯০ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তা হলে আপনিই বলুন মাননীয় সভাপতি রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত? অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জমা দেওয়া প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন মাত্র তিনজন সদস্য। তারা হলেন- প্রেমহরি বর্মা, ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী তার প্রস্তাবকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম থেমে থাকেনি সেখানেই। ১৯৪৭ সালে গড়ে ওঠা তমদ্দুন মজলিস, ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্র-জনতা। সভাস্থল থেকে মানি না মানবো না স্লোগানে মুখরিত হয় রেসকোর্স। অবাধ্য মায়ের সন্তান বাড়তে থাকে। শপথ ভঙ্গ হতে থাকে অজস্র প্রেমিক-প্রেমিকার। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, গুম ও হত্যা বাড়তে থাকে। এসবের তোয়াক্কা করেন না শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ জনতা।
ঘামে ভেজা রিকশাওয়ালার মুখে শোনা যায়, আমরা কি তাহলে বাংলায় কথা কইতে পারমু না? সারাদেশে বিশাল প্রতিরোধ গড়ে উঠল। মাঝে মাঝে যেন কোথা থেকে স্লোগান আসে- রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।
ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহরে ১৪৪ ধারা জারি। যা ভাঙতে প্রস্তুত অবাধ্য মায়ের সন্তানরা। এক সময় ভেঙে ফেলা হয় ১৪৪ ধারাসহ সব বেড়িকেট। বেলা বাড়ার সঙ্গে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা।
সিদ্ধান্ত হলো দশ জন করে বের হয়ে ভাঙবে ১৪৪ ধারা। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলটি বের হলে পুলিশ গ্রেপ্তর করে গাড়িতে তুলছে। কত জনকে আর গাড়িতে তুলবে, সবাই রাজপথে নেমে এলো। অতর্কিত গুলি। সামনে কয়েকটা লাশ। বসন্তের ঝরে যাওয়া পাতাও স্তব্ধ। বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এই তো আমার ভাইয়ের রক্ত। আমার একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশের চেতনায় তারুণ্যের ডাক আবারও আসবে। নিজের ভাষা, সংস্কৃতির ওপর থেকে আগ্রাসন মুক্তির। তরুণরা আবার গাইবে। আমি বাংলায় গান গাই, বাংলায় দেখি স্বপ্ন, বাংলায় বেঁচে রই। যে স্বপ্নে, গল্পে ও প্রেমে মিশে আছে বায়ান্নর স্লোগান, তারুণ্য।