সিয়াম মাহমুদ
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৫০ পিএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৫১ পিএম
আলোকচিত্রী : মোসাদ্দেক হোসেন
শীতঘুম থেকে তেড়েফুঁড়ে জেগে উঠবার ঋতু বসন্ত। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দেহ-মনে নিজেকে মেলে ধরার অদম্য বাসনা যেন জেগে ওঠে এই বসন্তেই। তাইতো বসন্ত নিয়ে এত মাতামাতি- রচিত হয়েছে সহস্র কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস। রবিঠাকুর লিখেছেন- আজি দক্ষিণ দুয়ার খোলা, এসো হে...। এই দিনে কবি দক্ষিণ দুয়ার খুলে রেখেছেন নতুনকে বরণ করতে।
ফাল্গুনী মাতাল হাওয়ায় উদাস বসন্ত প্রেম-প্রকৃতিকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রকৃতির মতো কবিতায়ও রূপ বদলে আসে বসন্ত। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমর পঙ্ক্তিতে, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত’। ফাগুনের আগুন নিয়ে প্রকৃতিতে হাজির বসন্ত। প্রকৃতির মাঝে ফুলকি ছড়াতে শুরু করেছে পলাশের আগুন। বসে নেই শিমুলও, রাঙিয়ে তুলেছে শাখা-প্রশাখা। আমের মুকুলের প্রাণ মাতানো ঘ্রাণ, হিমহিম এক মিষ্টি মধুর হাওয়া বইছে চারদিকে। ঋতুরাজ মানে শুকনো ঝরাপাতা আর ফোটা ফুলের মেলা। পাতা ঝরা শেষে নতুন রঙ লেগে গাছে সঞ্চার জাগরণের দিন, ফাগুনের দিন।
ঋতুরাজ বসন্তের বিচরণ এখন প্রকৃতিতে। তার আগমনে যেন তারুণ প্রাণের ছোঁয়া সর্বত্র। সবুজ পাতা গাছের ডালে ডালে। ধানক্ষেত আর বিস্তৃত মাঠে সবুজের ছড়াছড়ি। প্রকৃতি লাল-সবুজ আর হলুদে মিলেমিশে একাকার। স্নিগ্ধ মৃদু হাওয়া যেন পাগল করে দেয় দেহ-মন। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য তারুণ্যকে তৃষ্ণার্ত করে। এমন দিনে তারা চায় ঘুরে বেড়াতে, ধরার মাঝে ছড়িয়ে যেতে। বসন্তের পাখি তরুণকে ডাক দিয়ে যায়। ডেকে ডেকে বলে যায়, চলে এসো বাসন্তী সাজে- যেখানে প্রেম আর প্রকৃতি এক হয়ে মিশে গেছে।
এই বসন্তই যুগ যুগ তারুণ্যকে আন্দোলনের পথেও ধাবিত করেছে। মনে করিয়ে দেয় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা। গর্জে ওঠা ৭১-এর উত্তাল মার্চের কথা। ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে বসন্ত দিনের উত্থান। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বসন্তেই ঘটেছিল। বাঙালির বসন্ত মানে আন্দোলনে উত্তাল রাজপথ। তারুণ্য এই বসন্তের দিনে শপথ নেয় হার না মানার। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার, ন্যায্য দাবিতে জেগে ওঠার। অদম্য হয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলার। আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...। বসন্ত মানে আনন্দের হিল্লোল, প্রাণচঞ্চলতা, পূর্ণতা। সকালের সোনালি রোদ আর দখিন হাওয়া যেন ভালোবাসার জানান দেয়। প্রকৃতির সকল জীর্ণতা মুছে যায়। আপন সৌন্দর্যে সেজে ওঠে এ ধরা। কোকিলের সুমধুর ডাক বসন্তের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়, মাতিয়ে রাখে সবাইকে। শালিক, টিয়া, ভিমরাজ, বুলবুলির কিচিরমিচির শব্দে গাছের ডালপালা যেন প্রাণ ফিরে পায়।
বসন্ত মানেই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানা গাছে মুকুল আসার দিন। মানে, আগামীর অপার সম্ভাবনা ডাক দিয়ে যায়। মুকুলের গন্ধে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে।
বসন্তে প্রকৃতি লাস্যময়ী, যেন নববধূ বেশে সজ্জিত হয়। হৃদয়ে লাগে প্রেমের দোলা। দেহ-মনে ক্লান্তি দূর হয়। বলতে না পারা মনের গোপন কথাটিও ফাগুনের এই দিনে প্রিয়জনকে বলে দেওয়া যায়। ভালো লাগা ও ভালোবাসার সৌরভ ছড়ানো এবং মিলনের বার্তা দেয় বসন্ত।
বসন্তের কোমল বাতাস যেন শিহরন তোলে মনে, সুরেলা কণ্ঠে কেউ গান গায়। ফুলের ঘ্রাণে সুবাসিত হয় মেঠোপথ। হৃদয় যেন হিমেল হাওয়ায় মিশে যায়। আমাদের জীবনকে রঙিন ও মধুর করে তোলে। স্নিগ্ধ, শুভ্র, কোমল, নির্মল হতে শেখায়। নতুন করে বাঁচতে, ভালোবাসতে শেখায়। নতুনত্বে রাঙিয়ে মেতে উঠে, বসন্ত অদম্য হয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলতে শেখায়। তাইতো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ‘পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত উঠুক জেগে…’