মাধব চন্দ্র মণ্ডল
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৩ ১৯:৪৭ পিএম
বাড়ি থেকে পাত্র প্রায় ঠিক। পাত্র বিওএফএ ভালো বেতনে চাকরি করেন। পল্লবীর বড় দাদার কাপড়ের ব্যবসা। মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় হয় তার ব্যবসা থেকে। গ্রামে দানবীর হিসেবে পল্লবীর দাদার পরিচিতি আছে। কেউ যদি কখনও বিপদে পড়ে পল্লব রায়ের কাছে টাকা ধার চেয়েছেন তো কখনও খালি হাতে ফেরেননি।
সেই পল্লব দাদা পল্লবীকে খুব ভালোবাসেন। দাদা গ্রাম ছেড়ে ব্যবসার জন্য শহরে থাকেন আর এখানে এনে রেখেছেন তার ছোট বোন পল্লবীকে, শুধু পড়ালেখার জন্য। যদিও নদীর ওপারের কলেজেই তাকে পড়তে যেতে হয়।
এখন পল্লবীর লেখাপড়া শেষ। লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে। এর মধ্যেই একটি বেসরকারি স্কুলে পার্টটাইম চাকরি জোগাড় করেছে। যদিও এ চাকরিটির জন্য পল্লবীকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তার দাদা পল্লব রায় তাকে বহুবার বলেছেন চাকরি না করে দুয়েকটি টিউশনি করলেই চলবে। আর সময় নিয়ে চাকরির পড়া পড়লে কাজে দেবে।
পল্লব রায় শিক্ষিত না হলেও আধুনিক মানসিকতার মানুষ। কখন কী করতে হবে তা তিনি বেশ বোঝেন। দেখতে দেখতে বোনের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, তিনি সেটা লক্ষ করেছেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই পল্লব রায় তার বোনকে পাত্রস্থ করতে ব্যস্ত। এত ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে তিনি নারাজ। তাই এত তাড়াহুড়া। যেদিন পাত্রের বাড়ি পাকা কথা বলতে যাবেন তার আগের দিন পল্লব রায়কে তার স্ত্রী কাকলী বললেন, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। বলব কী?
কী ব্যাপার বলো তো, এত ইতস্তত করছ কেন? সরাসরি বলে ফেল।
তুমি তো পল্লবীর বিয়ে ঠিক করতে যাচ্ছ। এদিকে পল্লবী তো একটা ছেলেকে পছন্দ করে।
তা পছন্দ তো থাকতেই পারে। বর্তমান আধুনিক যুগের মেয়ে। তা পাত্রটা কেমন, কী কাজ করে, কোথায় থাকে, সব কিছু তুমি জানো কি?
না, আমি সব জানি না, তবে ছেলেটার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে।
ও তলে তলে এত!
আগে বললেই তো হতো।
আগেই তো বললাম। আমিই বা আগে জানব কোথায়। কদিন হলো জানলাম যখন তুমি ওর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলে তখনই পল্লবী আমাকে বলল।
পল্লব রায় বললেন, তাহলে পাত্রের পরিবারকে আসতে বলো, সব পাকা কথা বলে বিয়ে সম্পন্ন করি। আমাদের পক্ষ থেকে কোন বাধা নেই।
এদিকে কাকলী দেবী সব কথা তার ননদীকে খুলে বললেন। বললেন তোমার শ্রীকৃষ্ণকে ডেকে পাঠাও তোমার দাদা কথা বলতে চাচ্ছেন। তুমি যা চাও তা-ই হবে, এটাও বলেছেন তোমার দাদা।
একদিন ছেলেটি পল্লবীর দাদার কাছে এসেছিল। তবে অনুপম এখন বিয়ে করতে রাজি নয়। লেখাপড়া শেষ করেছে, এখন একটি চাকরি নিয়ে তার পর বিয়ে করতে চায়। অন্যদিকে তার বাড়িতেও রাজি নয়, কারণ বাবা জানে যে তার ছেলে বেকার। বিয়ে করলে চলবে কী করে।
অনুপম বালু নদীর পাড়ে বসে আকাশের দিকে তাকাতেই লক্ষ করল ওপরে কদমগাছে প্রচুর কদম ফুল ফুটে আছে। কদমের সুগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক অন্যরকম ঘোর তৈরি করেছে । কীসের যেন একটা অভাববোধ করে অনুপম। ভাবতে ভাবতে চোখ দুটি মুদে আসে। হঠাৎ কোন জগতে হারিয়ে গেল তার আর ইয়ত্তা পাওয়া গেল না। তবে মনে পড়ে গেল সেই বর্ষার কথা, যেদিন প্রথম পল্লবীর সঙ্গে তার দেখা।
সেদিন হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। অনুপম কদমতলায় বসে গাছের একটু আড়ালে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। তখনই কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার জন্য গুদারা ঘাটে আসতেছিল পল্লবী। হঠাৎ ও মাগো বলে চিৎকার শোনা গেলেও কাউকে দেখা গেল না। অনুপম ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে টেনে ওঠাল। হাত ধরে পল্লবী উঠল ঠিকই, কিন্তু অনুপমের হাতে থাকা কদমগুচ্ছ পল্লবীর হাতে রয়ে গেল। অনুপমের মনেই পড়ল না কদম ফুলের কথা। কখন যে হৃদয় বিনিময় হয়ে গেল, কেউ বুঝতে পারল না, এদিকে বৃষ্টি বাড়তে থাকল। তখন শুধু কোথাও বেজে চলেছিল রবীন্দ্রনাথের সেই গান। এমনও দিনে তারে বলা যায়...
একসময় পল্লবীকে খুব ভালোবেসে ফেলে অনুপম। প্রতি জন্মদিনে একগুচ্ছ কদম ফুল না দিলে যেন জন্মদিন অপূর্ণই থেকে যায়। এখানে এসেই প্রতি জন্মদিন পালন করা হতো। এদিকে অনুপম বাবা-মাকে রাজি করাতে না পেরে ফোনে তার অপারগতার কথা ব্যক্ত করে। বলে যে আমার পক্ষে হয়তো তোমাকে বিয়ে করা এ মুহূর্তে সম্ভব হবে না, তুমি নতুন চিন্তা করো।
সেদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর, কিন্তু পল্লবীর ঘুম ভাঙার কোনো খবর নেই। সেদিনও বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কাকলী রায়ের নিকট কেমন যেন মনে হচ্ছিল। অনেক ডাকাডাকি করে যখন কাজ হলো না তখন তিনি পল্লব রায়কে বললে পল্লব রায় ঘরের দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেন। ভেতরটা ভেসে যাচ্ছে রক্তে আর ক্ষতবিক্ষত হাতটা বিছানার একপাশে ঝুলে আছে। সবাই কতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল, কেউ জানে না।
অনুপম নিয়ম করে এখনও কদমগাছটার তলে আসে। গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। গাছ বড় হয়েছে, তার পরও এখন কদম ফুল নেই। আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। বৃষ্টির জল ও চোখের জলে একাকার হয়ে মিশে যায় নদীর জলে। একসমুদ্র হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছে আর কদম ফোটে না।