প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:০৪ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:১০ পিএম
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একুশের বইমেলায় দর্শনার্থীদের ভিড়। প্রবা ফটো
ভাষার অধিকার আদায়ে রক্ত ঝরানোর দিন আজ। প্রতিটি বাঙালির আবেগের দিন। এই দিনে একুশের বইমেলা জমে ওঠাই স্বাভাবিক। এবার করোনা মহামারির বিধিনিষেধের বালাই নেই। বাংলা একাডেমি ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুটজুড়ে ১ ফেব্রুয়ারি যে প্রাণের উৎসব শুরু হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে তা যেন পরিপূর্ণতা পেল।
ভোরে শোক ও শ্রদ্ধার ফুলে বায়ান্নর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর হাজারো মানুষের গন্তব্য হয়ে ওঠে বইমেলা প্রাঙ্গণ। মেলা প্রান্তরে বয়ে যায় প্রাণের প্রবাহ; জনসমাগমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে বই বিক্রি। প্যাভিলিয়নগুলোতে প্রিয় লেখকের উপস্থিতির কারণে ক্রেতাদের জটলা দেখা গেছে।
আজ বইমেলার ফটক খোলে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। ছুটির এই দিনে বরাবরের মতো শহীদ মিনার থেকেই ছোটে জনস্রোত। আজ মেলায় আগতদের বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। মা-বাবার হাত ধরে এসেছে শিশুরাও। কেউ শোকের সাদা-কালো পোশাকে, কেউবা ফাগুনের সাজে বেরিয়েছেন। সব মিলিয়ে মেলার দুই প্রাঙ্গণ কানায় কানায় পূর্ণ।
মেলা প্রাঙ্গণে আসা তরুণেরা জানান, বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগে বাঙালি যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, সেই পথ ধরে বাংলাভাষার উৎকর্ষ সাধনের পথে অবদান রাখতে চান তারা। সময়ের প্রয়োজনে বিদেশি ভাষা শিখতে হলেও মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চার সঙ্গে বর্ণমালার যথেচ্ছা বিকৃতিও রোধ করবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী অনিন্দিতা সাহা বলেন, ‘ভিনদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা বাংলাকে ভুলতে বসেছি। প্রমিত বাংলার চর্চা কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেছে। আমরা প্রমিত বাংলার চর্চা করব, শুদ্ধ বাংলায় কথা বলব। বাংলার এতটুকু বিকৃতি আমরা সইব না।’
রাজধানীর মুগদা থেকে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বইমেলায় এসেছেন নাহিদা আলম। তিনি বলেন, ‘ভেবেছিলাম দুপুরে লোকজন কম থাকবে। একটু পর থেকেই দেখি মানুষের ঢল। বাচ্চাদের নিয়ে মেলা থেকে বের হওয়াই দুঃসাধ্য।’
যাত্রাবাড়ীর সবুজ বিদ্যাপীঠের ইবাদুন মাহবুব তাহান ও বিএএফ শাহীন কলেজের শাফিন আহমেদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর চলে আসেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সাফিন বলেন, ‘আমি ফিকশন পড়তে ভালোবাসি, আমার বন্ধুরাও তাই। এ সময়ে ভারতের বেশ কজন ফিকশন লেখকের বইও দেখলাম মেলায় আসছে। কিন্তু ভাষার মাসে আমরা কেবল বাংলাদেশি লেখকের বই কিনব।’
শুধু রাজধানী বা আশপাশের জেলা থেকে নয়। আজ প্রাণের মেলায় আসছেন অন্যান্য জেলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অনেকেই। তেমনি একজন কিশোরগঞ্জের আজিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহনাফ আবিদ। আবিদ বলে, ‘মেলায় এসে বড় পরিসরে এত এত বই দেখে খুব ভালো লাগছে। পছন্দের কিছু বই কিনব।’
দুপুরে বইমেলা প্রাঙ্গণে কথা হয় টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের (টিঅ্যান্ডটি) সাবেক কর্মকর্তা নাজমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু গল্প-উপন্যাস ও সায়েন্স ফিকশনের বই কিনে দিলে হবে না, কিশোরদের হাতে ইতিহাসের বইটিও তুলে দিতে হবে। যে তরুণ সবে সাহিত্যপাঠে মনোনিবেশ করেছে, তার হাতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে দিতে হবে।’
মেলায় বিপুল জনসমাগমে খুশি প্রকাশক-বিক্রেতারাও। তাদের ভাষ্য, আজকেই সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হবে। কাকলী প্রকাশনীর কর্ণধার এ কে নাসির আহমেদ সেলিম বলেন, ‘সকাল থেকে বিপুল পাঠক সমাগম হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যে পরিমাণ প্রত্যাশা করেছি, তার চেয়ে বেশি সমাগম হয়েছে। বেচাকেনাও ভালো হচ্ছে।’
কথাপ্রকাশের মালিক জসিম উদ্দিন ও ইত্যাদির অন্যতম কর্ণধার জহিরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, ’গত ২০ দিনে বইমেলায় যত বই বিক্রি হয়েছে, তার তিন থেকে চারগুণ বই বিক্রির পর্বটি শুরু হয়েছে আজ থেকে। বইমেলার শেষ সপ্তাহে প্রকাশকরা নতুন বই আনবেন। মনের খোরাক মেটাতে সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের ভিড়ে মেলা প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই থাকবে না শেষের সাত দিন।’
চারুলিপির কর্ণধার হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এবার অনেক প্রকাশক বইমেলার শুরু বা মাঝামাঝির দিকে নতুন বই বের করতে পারেননি। আমার প্রকাশনী থেকেও বেশকিছু বই এখনও মেলায় আসার অপেক্ষায়। অনেক পাঠক নতুন বইয়ের সন্ধান করে ফিরে গেছেন। এবার কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও সংকটে নতুন বইয়ের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। তারপরও আশা করছি, পাঠক তার রুচিসম্মত বইটি মেলায় এসে ঠিকই খুঁজে পাবেন।’
মেলায় যত আয়োজন
একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচি শুরু করে বাংলা একাডেমি। মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি জাহিদুল হক।
বিকাল ৪টায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা-২০২৩। এতে স্মারক বক্তব্য দেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এরপর একই মঞ্চে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।