মেসবাহুল হক
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:৫২ পিএম
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২ ২০:০০ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
পাঁচ মাস ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে জাপান সরকারের দেওয়া ৭৭ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জাম খালাস করতে ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। এ টাকার সংস্থান না থাকায় এতোদিন এসব চিকিৎসা সামগ্রি খালাস করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। অবশেষে এ টাকা বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়েছে অর্থ বিভাগ। শিগগির এ টাকা ছাড় করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জাপান সরকার বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম বাংলাদেশকে দিয়েছে। কিন্তু এ খাতে বরাদ্দ না থাকায় শুল্ক পরিশোধ করে এসব পণ্য খালাস করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। এ প্রেক্ষিতে সম্প্র্র্রতি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মাধ্যমে শুল্ক-কর বাবদ ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়েছে অর্থ বিভাগ। শিগগির এ অর্থ ছাড় করা হবে।
জানা গেছে, জাপানের দেওয়া চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বহনযোগ্য এক্স-রে যন্ত্র, রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মনিটর, সিটি স্ক্যানার, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি বা ইসিজি যন্ত্র, ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার ও অক্সিজেন জেনারেটর। আরও রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংখ্যা ৩১৩।
সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো বলছে, চিকিৎসা সরঞ্জামগুলো পাওয়ার কথা সিএমএসডির। তারা বলছে, এসব সরঞ্জাম খালাস করতে শুল্প-কর আসে ২২ কোটি টাকা। সেই টাকা তাদের নেই। তারা এই শুল্কছাড় অথবা অর্থ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত জুলাই থেকে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। ওদিকে বন্দরের মাশুলও (চার্জ) বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি যন্ত্রপাতি দ্রুত খালাসের অনুরোধ জানান।
জানা গেছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম অনুদান দিতে জাপান ২০২০ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে। চুক্তির আওতায় সরঞ্জামগুলো কয়েকটি চালানে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে গত জুনে। এসব সরঞ্জাম ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করার কথা। নথিপত্রে দেখা যায়, গত ২৮ জুলাই সিএমএসডি একটি চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। সেখানে জাপানের চিকিৎসা সরঞ্জাম খালাসের জন্য শুল্ক-কর বাবদ অর্থ চাওয়া হয়। সর্বশেষ গত ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, অর্থসচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান ও নৌপরিবহন সচিবকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এনবিআর সূত্র বলছে, সরকারের নির্ধারিত কিছু খাত ছাড়া সব পণ্যেই শুল্ক-কর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। অনুদানের সরঞ্জামে শুল্ক ছাড় দিতে হলে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। ওদিকে বন্দরের মাশুল মওকুফ করার ক্ষমতা রয়েছে শুধু নৌ প্রতিমন্ত্রীর।
জানা যায়, দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে চিকিৎসা সরঞ্জাম পড়ে থাকার ঘটনা আগেও ঘটেছে। গত এপ্রিলে বৈশ্বিক একাধিক সংস্থা ও তহবিল থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে ছিল। শুল্ক ও কর পরিশোধ করে বন্দর থেকে পণ্য খালাস না করায় অনুদান হিসেবে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ফেরত নেওয়ার ঘোষণা দেয় গ্লোবাল ফান্ড। এসব স্বাস্থ্যপণ্যের মধ্যে রয়েছে কৃমিনাশক ট্যাবলেট, যক্ষ্মানিরোধ চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও সিরিঞ্জ। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এরপর গ্লোবাল ফান্ড ছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার চিকিৎসা উপকরণ খালাসে তৎপরতা শুরু হয়। খালাস হয় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে।
স্বাস্থ্য খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে মূল্যবান স্বাস্থ্য সরঞ্জাম পড়ে থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক। জনস্বার্থ বিবেচনা করে এনবিআর ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কিছুটা অথবা পূর্ণ শুল্ক ছাড় দিতে পারে। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছু থোক বরাদ্দ থাকে, যেখান থেকে চাইলে তারা জরুরিভাবে বরাদ্দ দিতে পারে। এভাবে দিনের পর দিন যদি চিকিৎসা সরঞ্জাম বন্দরে পড়ে থাকে, তাহলে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাছাড়া গ্লোবাল ফান্ডের পণ্য ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি উদাহরণ হয়ে থাকবে যে, বাংলাদেশকে বিনা পয়সায় পণ্য দিলেও তারা গ্রহণ করতে পারে না। তখন অন্যান্য দাতা সংস্থাও আর এগিয়ে আসবে না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এটা আমাদের চরম ব্যর্থতা। বিভিন্ন দাতা সংস্থা চিকিৎসাসামগ্রী অনুদান হিসেবে দিচ্ছে, সেগুলো আমরা সময়মত গ্রহণ করতে পারছি না। ভবিষ্যতে এটা উদাহরণ হয়ে থাকবে যে, বাংলাদেশকে বিনা পয়সায় পণ্য দিলেও তারা গ্রহণ করতে পারে না। তখন অন্যান্য দাতা সংস্থাও আর এগিয়ে আসবে না। এর ফলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা মাধ্যমও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই এসব ক্ষেত্রে বন্দর থেকে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ছাড় করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক।