আমিনুল ইসলাম মিঠু
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৮ এএম
আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৯ পিএম
ফাইল ফটো
‘অনেকদিন ধরেই হাতে ফোসকার মতো হচ্ছে। জানি না এগুলো কী কারণে হচ্ছে। কখনও কমে যায় কখনও বাড়ে।’ নিজের হাত দেখিয়ে বলছিলেন বিল্লাল হোসেন। রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে হাঁস-মুরগির দোকান চালান এই তরুণ। তার পাশের দোকানি হাবীব ও সজিবেরও একই অভিজ্ঞতা।
তারা বলেন, আগে হাঁচি-কাশি হতো। তবে কখনও জ্বরে আক্রান্ত হননি। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেন কি না জানতে চাইলে তারা একই উত্তর দেন, ‘এগুলো তো স্বাভাবিক বিষয়।’ এ পরিবেশে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
নাকে-মুখে রুমাল চেপে মুরগির বাজারে ঢুকলেন মোরশেদা সুলতানা (ছদ্মনাম)। কথা হলে তিনি বলেন, ‘এখানে আসা যায় না। আসার মতো অবস্থা নেই। তবু আসতে হয়।’ জানালেন, মাস্ক ছাড়া হাঁস-মুরগির বাজারে এলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। মুরগি পাখা ঝাপটা দিলে ধুলাসহ পাখনার অংশ বাতাসে ওড়ে। বাচ্চাদের নিয়ে এলে তাদের হাঁচি-কাশি দেখা দেয়। এখন আর বাচ্চাদের বাজারে আনেন না।
রাজধানীর সব মুরগির বাজারের একই হাল। এখান থেকে ফ্লুজনিত রোগব্যাধি ছড়ানোর নজির অনেক। সরকারি গবেষণায়ও সেসব তথ্য এসেছে। অবস্থার পরিবর্তন করতে না পারায় বিষয়টি লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারাই এমন তথ্য জানিয়েছেন।
শুধু রাজধানী নয়, অন্যান্য শহর, গ্রাম, পাড়া-মহল্লা- সর্বত্রই উন্মুক্ত ও জনবহুল পরিবেশে যত্রতত্র গড়ে ওঠা পাখির (হাঁস-মুরগি ইত্যাদি) বাজার সংক্রামক রোগের হটস্পট। গবেষণা বলছে, এখান থেকে এসব পাখির পাশাপাশি মানবদেহে সংক্রমিত হচ্ছে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, যা আগামীতে মানুষ ও পাখিজাতীয় প্রাণীর ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তায়ও দেখা দিতে পারে বড় রকম চ্যালেঞ্জ।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডা. আহসানুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামের উন্মুক্ত হাঁস-মুরগির বাজার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। এসব বাজারে সারা দেশ থেকে হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন প্রাণী আসে। আমরা গবেষণাকালে দেখেছি খামারে জীবন্ত মুরগির ১ শতাংশ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে বাজারে আসার পর তা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়।’
বাংলাদেশের পোল্টি শিল্পে এইচ৫এন১ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাজারে যে পরিবেশে হাঁস-মুরগি রাখা ও জবাই করা হয় তা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এখান থেকেই ভাইরাস প্রাণী থেকে প্রাণীতে ও মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।’
এ পর্যন্ত দেশে যারা এভিয়ান ইনফ্লয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই অল্পবয়সি জানিয়ে তিনি বলেন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় এ বয়সি মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিশ্বে এভিয়ান ইনফ্লয়েঞ্জার ১৬টি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এগুলো দ্রুত পরিবর্তন হয়। যদি শক্তিশালী ভাইরাসে রূপ নেয়, তবে মহামারির আশঙ্কাও থাকে। বুনো পাখিতে বিশেষ করে শীতে আসা পরিযায়ী পাখি ১৬টি ভ্যারিয়েন্ট বহন করে। মূলত শীত মৌসুমে এভিয়ান ইনফ্লয়েঞ্জা ছড়ানোর সুযোগ বেশি থাকে। তিনি অচিরেই উন্মুক্ত হাঁস-মুরগিসহ পাখিজাতীয় প্রাণীর বিপণন বন্ধ করার আহ্বান জানান।
ফ্লুজনিত রোগ
গবেষকরা জানান, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নামের এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়ালে জ্বর, কাশি, গলা ও পেশিতে ব্যথা থেকে বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, চোখের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া এবং গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হন। অনেক ক্ষেত্রে মারা যায় রোগী।
প্রাণিসম্পদ গবেষকরা বলছেন, ২০০৭ সালে দেশের ৫৪ জেলায় বার্ড ফ্লুর প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল, যা এখন প্রায় বিস্মৃত। হাঁস-মুরগির পাশাপাশি ওই সময় আক্রান্ত হন আটজন মানুষ। তাদের মধ্যে একজন মারা যান।
আইইডিসিআরের ইকোহেলথ প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আরিফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত রোগে কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এর একটি প্রতিবেদন করা জরুরি।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর হাঁস-মুরগিসহ পাখিজাতীয় প্রাণীর দেহে হাই প্যাথজেন এইচ৫এন২ এবং লো প্যাথজেন এইচ৯এন২ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন কি না বা উপসর্গ বহন করছেন কি না তা নির্ণয় করা জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের মধ্যে প্যাথজেন সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার উদ্যোগ নেয়। এজন্য জীবন্ত পাখির ব্যবসার জন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ইপিডিমিওলজির প্রধান ওসমান গণিসহ ১৩ জন গবেষক রাজধানীর উন্মুক্ত পাখিবাজার নিয়ে গবেষণা করেছেন। ‘রিস্ক এরিয়া ফর ইনফ্লুয়েঞ্জা এইচ৫ এনভায়রনমেন্টাল কন্টামিনেশন ইন লাইভ বার্ড মার্কেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তারা বলেছেন, ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে এএইচ৫ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ৫৫৬টি প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।
মুরগির খামারে নিরাপত্তা
ওসমান গণি বলছেন, লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন খামারিরা। বেশি ঝুঁকিতে আছে ব্রয়লার ও সোনালি জাতের মুরগি। এ দুই জাতের মুরগি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয় বেশি। আর দ্রুত বাজারেও বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ কারণে মনিটরিংসহ বাজারগুলোতে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য অধিদপ্তর স্টপ স্পিলওভার নামের নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছে। প্রকল্পের কাজ চলমান।
এভিয়ান ইনফ্লয়েঞ্জায় খামারি, বিক্রেতা ও ক্রেতারা আক্রান্ত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, ২০০৮ সালের পর এখন পর্যন্ত নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য রেকর্ড হয়নি। তবে ঢাকাসহ দেশের উন্মুক্ত বাজারগুলো এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ঝুঁকিপূর্ণ। উন্মুক্তভাবে হাঁস-মুরগি বিক্রি, সেগুলোর বিষ্ঠা ও জবাইয়ের পর দেহের অবশিষ্ট অংশ যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয়, যা পানি বা পরিবেশের সঙ্গে মিশে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
সরকার কেন তথ্য গোপন করে
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ১৭ কোটি ১৭ লাখ। তাদের আমিষের চাহিদা মেটাতে হাঁস-মুরগি উৎপাদন দারকার ৩৭ কোটি ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার। প্রায় ৬০ লাখ মানুষ পাখিজাতীয় প্রাণী লালন-পালন খাতে নিয়োজিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক বলেন, কৃষক ও ভোক্তারা যাতে আতঙ্কিত না হন, দেশের প্রাণিজ আমিষের সরবরাহ সচল রাখতে এবং এই শিল্পের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে যেসব খামারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়ায়, তাদের তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
তবে খামার ও বাজারে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক ডা. নিলুফার বেগম।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, ‘উন্মুক্ত পাখির বাজার ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হবে। দেরিতে হলেও ইতোমধ্যে হাঁস-মুরগির খামার ও বাজারজাতকরণে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিতে খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে, শিগগির তা চূড়ান্ত হবে। তবে উন্মুক্ত পাখির বাজারের জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ভূমিকা বেশি। আগে অধিদপ্তর থেকে ভেটেরিনারিয়ান বাজার পরিদর্শন করত, কিন্তু এখন বন্ধ রয়েছে। ঢাকায় সিটি করপোরেশন থেকে নিজস্ব কর্মকর্তা তদারকি করেন, প্রয়োজন হলে আমরাও সহযোগিতা করি। বাজার নিয়ন্ত্রণে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ ও দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু তা প্রকাশ করছে না প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এ ছাড়া অনেক সময় মাঠপর্যায় থেকেও আক্রান্ত খামারের তথ্য গোপন করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক মানুষের জীবিকা এই খাতের সঙ্গে জড়িত।’ তা ছাড়া ক্রেতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখনও সেকেলে। তারা চান তার সামনেই জবাই করে হাঁস-মুরগি ক্রয় করবেন। তবে আমরা চেষ্টা করছি বাজারগুলোকে একটি কাঠামোতে আনতে।
২০২১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘লাইভ বার্ড মার্কেট ইন বাংলাদেশ
রেগুলেটরি সিস্টেমস অ্যান্ড অপারেশন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে উন্মুক্ত পাখির বাজার জীবন্ত হাঁস-মুরগির ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দেশটির ৯টি পাখির বাজার নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং কার্যকর জৈব নিরাপত্তা মেনে চলা বা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেই সেখানে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে আফতাব বহুমুখী ফার্ম লি., এজি এগ্রো, ব্র্যাক, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগণ গ্রুপ, ইয়ন গ্রুপ ও এটিআর হাঁস-মুরগি প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক ব্যবস্থাপনায় জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মান নিয়ন্ত্রণে রেখে খামার পর্যায়ে সেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
অন্যদিকে মান নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাপর্যায়ে হাঁস-মুরগি পৌঁছে দিচ্ছে আরও ১৭টি প্রতিষ্ঠান। হাঁস, মুরগি, কবুতর, কোয়েল ও টার্কির মোট খামারের সংখ্যা এখন ৮৭ হাজার ২৭৩। গত জানুয়ারিতে নতুন করে নিবন্ধন পায় আরও ১৫২টি।