শেষ হইয়াও হইল না শেষ
এম আর মাসফি
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৯ পিএম
আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৩ ১৪:১৬ পিএম
পদ্মা সেতুতে চলছে গাড়ি।
দেশের মানুষের বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় সেতুর আরও কিছু কাজ বাকি ছিল, যা আসন্ন জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি’র নামে এসব কাজ সম্পন্ন করার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। সংস্থাটি নতুন করে ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছে। এর ফলে যে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় ছিল মাত্র ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা, তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো পদ্মা সেতু প্রকল্পের এই তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাবনায় সেতু ও নদীশাসনে পরামর্শক খাতে ৫৭৩ কোটি টাকা, নদীশাসন ও সার্ভিস এরিয়ার মাটি ভরাটে ৮৭৭ কোটি টাকা, মূল সেতু নির্মাণে ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালট্যান্ট এবং অডিট খাতে ৩১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। যার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
শেষ মুহূর্তে এসে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আগের তুলনায় ডলারের দাম অনেক বেড়েছে। তাই এ ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া সিডি ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হওয়ায় খরচ বেড়েছে। সেতুর কাজ সম্পন্ন করার জন্য সময় আরও এক বছর বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জুনের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের জন্য আমরা আরও এক বছর সময় চেয়েছি।’
দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে মূল সেতু ও নদীশাসন খাতে ৪ হাজার ১৪৪ জনমাস পরামর্শক খরচ ধরা ছিল ৩৮৩ কোটি টাকা। অথচ তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে ২ হাজার ৯৬৫ জনমাস পরামর্শকের জন্য ধরা হয়েছে ৯৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১ হাজার ১৭৯ জনমাস পরামর্শক কমলেও ব্যয় ৫৭৩ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পরামর্শক কমলেও ব্যয় বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। পরিকল্পনা কমিশন চাইলে সেটা দেবে আর বেশি মনে করলে কমিয়ে দেবে। এটা নিয়ে পিইসি সভায় আলোচনা হবে। মোবাইল ফোনে কথা বলে এটা বোঝানো যাবে না।’
ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবনায় বলা হয়, পদ্মা সেতু চালুর পর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে। অপটিক ফাইবার কেবল স্থাপন করা হচ্ছে। টোল প্লাজা এলাকায় বাড়তি নানান কাজও করতে হচ্ছে। বাস-বে ও ট্রাকের জন্য বিশেষায়িত লেন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আনসার ব্যারাক, জাদুঘরসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর কারণে ব্যয় বাড়ছে।
এর বাইরে পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়েছে। যা নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর ২২টি পিয়ারের নকশা সংশোধন এবং ৭টি ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন টাওয়ার নির্মাণ বাবদও প্রকল্পের খরচ বেড়েছে।
পদ্মা সেতুর নদীশাসনকাজে ব্যবহৃত জিও ব্যাগের মূল্যবৃদ্ধি সার্বিক নির্মাণ ব্যয়ে প্রভাব ফেলেছে। এসবের বাইরে ডলার এবং বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ছে বলে তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়, আগে বিদেশি ঠিকাদারের জন্য ভ্যাট ও ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। এখন তা ১৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এ কারণে এ খাতে অতিরিক্ত ৬৮৭ কোটি টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত ৪৩ মাস সময় লাগছে।
নদীশাসনকাজের জন্য অতিরিক্ত সময় লাগছে ৫৫ মাস। অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রকল্পের পরামর্শক (কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট) খাতে ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে।
প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। এটি বাড়িয়ে ১৩ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে নদীশাসনকাজের জন্য ৯ হাজার ৪০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরামর্শক খাতের ব্যয় ৭৮৮ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকায় উন্নীতের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের শেষ সময়ে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডের জন্য এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডলারের দাম ও সিডি ভ্যাট বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কিছু খাতে ব্যয় বাড়িয়ে তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমরা এ ব্যয় প্রস্তাব যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পরিকল্পনা কমিশন, আইএমইডি, সেতু বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি উপকমিটি করে দিয়েছি। এই কমিটি প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করবে এবং ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে। তারপর বোঝা যাবে ব্যয় কত দাঁড়াচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখেই ব্যয় অনুমোদন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এটাই শেষবার। এরপর আর ব্যয় বাড়ানো হবে না। ডিফেক্ট লায়াবিলিটির জন্যই এটা বাড়ানো হচ্ছে। ডলারের রেটের কারণেও খানিকটা বাড়ছে। এ ছাড়া এসব বড় প্রকল্পে কিছু ক্লেইম থাকে, যেগুলো সেটল হওয়া সময়সাপেক্ষ। এ কারণেও কিছু টাকা রাখা হচ্ছে। যেটা প্রয়োজন হলে খরচ করা হবে।’ পরামর্শক খাতের ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু খাতে পরামর্শক কম হলেও বেশি খরচ লাগে। তা ছাড়া কাজ করা যায় না।
প্রকল্পের প্রস্তাবনা সূত্রে জানা যায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প ২০০৭ সালের জুলাই মাসে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে জুন ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য এটির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন পায়। এরপর ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তিনবার সময় বাড়িয়ে জুন ২০২৩ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। মাঝে বিশেষ সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন ডিফেক্ট লায়াবিলিটির নামে আরও ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সময় চেয়ে তৃতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে।