বিশেষ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৩ ১০:৩৪ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৩ ১৪:২৭ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে হাজার হাজার ভবন ধসে গেছে। অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন তুরস্ক সরকার ধসে যাওয়া ভবন নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এ কারণে সর্বাধিক ইস্পাতের চাহিদা বেড়েছে তুরস্কে। তাই উচ্চমূল্যে ইস্পাত কিনছে দেশটি। এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অস্থিরতা তো আছেই। ভূমিকম্পের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের গড় দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪৬০ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে ৮০ ডলার বেড়ে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ ডলার দামে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইস্পাতের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। সেখানে উৎপাদন হয় প্রায় এক কোটি টন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে উৎপাদন হয় অন্তত ৪০ লাখ মেট্রিক টন। এর প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডগুলো থেকে চাহিদার তুলনায় মেল্টিং স্ক্র্যাপ পাওয়া যায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। বাকিটা আমদানি করতে হয়। ডলার জটিলতায় স্ক্র্যাপ আমদানি সংকটে পড়ায় পুরো ইস্পাত শিল্পে নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, মহামারি কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে গত দুই বছর বিশ্ববাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের দাম ছিল বাড়তি। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে কাঁচামালের দাম আরও বাড়ে। এতে রডের দাম অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাঝখানে কিছুটা কমলেও এখন তুরস্কে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দাম বাড়ছে।
গত বছরের শেষার্ধে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম স্বাভাবিক হলে রডের দামও কিছুটা কমে আসে। কিন্তু দেশে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় কমেনি। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। জ্বালানি সংকটে দৈনিক এক বেলা করে উৎপাদন বন্ধ রাখে বেশিরভাগ কারখানা। বিরতিহীন উৎপাদন করতে না পারায় খরচ বেড়ে যায়। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার, যার প্রভাবে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যায়। ইস্পাত কারখানা মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি কমাতে হয়েছে ৫০ শতাংশ। আবার রডের দাম বেশি হওয়ায় চাহিদা কম।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গত দুই বছরে রডের উৎপাদন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয় মূল্য সমন্বয় না হওয়ায় ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ৫০টি ইস্পাত কারখানার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৪৩টি। এখন চালু আছে মাত্র সাতটি। অর্থাৎ সরবরাহ লাইনে ধস শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে রড আমদানির মতো সংকটময় সময় শুরুর আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের ডিএমডি তপন সেন গুপ্ত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘করোনার পর থেকে ইস্পাত খাতে নানামুখী সংকট চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন মেল্টিং স্ক্র্যাপের দাম ঠেকে ৭৫০ ডলারে। ডেফার্ড এলসির মাধ্যমে আমদানি করা এসব কাঁচামালের পেমেন্ট গুনতে হয়েছে ডলারপ্রতি ১১৫ টাকা। মাঝখানে কাঁচামালের দাম কিছুটা কমেছিল। তুরস্কে ভূমিকম্পের পর এখন আকাশচুম্বী। এর সঙ্গে ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি- সব হিসাব করলে প্রতি মেট্রিক টন রড উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ টাকার বেশি।’
চিটাগাং স্টিল রি-রোলিং মিলস ওনার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য, বর্তমানে ৭৫ গ্রেডের (টিএমটি) বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এমএস রড এক লাখ টাকার আশপাশে এবং সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রড ৯৪-৯৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
লোকসানের মধ্যেও কারখানা চালু রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে তপন সেন বলেন, ‘উৎপাদন বন্ধ রাখলে লোকসান আরও বাড়বে। প্রতিটি কারখানার বা কোম্পানির বড় অঙ্কের স্থায়ী ব্যয় থাকে। এ ছাড়া কারখানা বন্ধ হলে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। তাই কঠিন এই সময়ে টিকে থাকার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে।’
শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত কারখানা কেএসআরএমের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘রড উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ। ডলার সংকটের কারণে গত অক্টোবর থেকে কেএসআরএম এলসি খুলতে পারেনি। ফলে কাঁচামাল আমদানি সম্ভব হয়নি। তখন থেকে গুদামে থাকা মজুদ কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে নেওয়া হয়। এখন মজুদ প্রায় শেষ। আমদানিও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে উৎপাদন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে যদি এখনই এলসি খোলার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে কিছু স্ক্র্যাপ আমদানি করা যাবে। না হলে উৎপাদন চালু রাখা যাবে না।’
চিটাগাং স্টিল রি-রোলিং মিলস ওনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এম মনজুর আলম বিষয়টি আরও একটু ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে অটো (৭৫ গ্রেড), সেমি অটো (৬০ গ্রেড) ও ম্যানুয়ালসহ (৪০ গ্রেড) প্রায় ৫০টি ইস্পাত কারখানা ছিল। এর মধ্যে ৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয় মূল্য সমন্বয় করতে না পারায়। ফলে বেকার হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক।’
সেমি অটো কারখানাগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে পেনিনসুলা স্টিল, এসএল স্টিল, নাজিয়া স্টিল, বিএম স্টিল, ইউনিভার্সেল স্টিল, বলাকা স্টিল ও আম্বিয়া স্টিল। এর আগে গত দুই বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম), এহসান রি-রোলিং মিলস লিমিটেড, রাইজিং স্টিল, এম কে স্টিল বিল্ডার্স লিমিটেড, ইসলাম স্টিলস লিমিটেড, ইউনিক স্টিল, খলিল স্টিল, ভাটিয়ারি স্টিল, মজিদ স্টিল, মানতি স্টিল, ব্রাদার্স ইস্পাত, আম্বিয়া স্টিল, হিলভিউ স্টিল, সুপার স্টিল, শফিউল আলম স্টিল, দিনার স্টিল ও এমটি স্টিলস লিমেটেড। কোনোভাবে উৎপাদন চালু রেখেছে এইচএম স্টিল, গোল্ডেন স্টিল, কেআর স্টিল, বায়েজিদ স্টিল, এশিয়া স্টিল, শীতলপুর স্টিল ও সীমা স্টিল।
বন্ধ হয়ে যাওয়া আবদুল ওয়াহাব স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পর কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, দাম বৃদ্ধি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত দুটি কারখানায় প্রায় ছয় কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। লোকসান টানতে না পেরে জুলাইয়ের পর থেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি। এতে কারখানা দুটির প্রায় ২০০ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। এরপরও স্থায়ী কর্মীদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল মিলে দুটি কারখানায় এখনও প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। কারখানা বন্ধ থাকায় ব্যাংকঋণের কিস্তিও দিতে পারছি না। যেখানে প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক সুদ যোগ হচ্ছে।’
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে পারে সরকার। ডলার সংকট কাটাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও রডের দাম বৃদ্ধি করে শিল্পকে রক্ষা করতে পারে। নাহলে ইস্পাত শিল্প টিকে থাকবে না।’