জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১১:৪০ এএম
আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩ ১৩:২১ পিএম
একদিকে বাড়ছে ঋণখেলাপি, অন্যদিকে অর্থঋণ আদালতের মামলা। কিন্তু ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে বাদ পড়া এসব অর্থ আদায়ে তেমন কোনো গতি নেই। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা বাড়লেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুব কম।
২০২২ সাল শেষে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। ছয় মাস আগে জুন শেষে ৬৯ হাজার ৩৬৯টি মামলার বিপরীতে ঝুলে ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলায় ব্যাংকের দাবি করা টাকার পরিমাণ বেড়েছে ১৯ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। একই সময়ে মামলা বেড়েছে ৮ হাজার ৩৪৪টি। কিন্তু পুরো এক বছরে (২০২২) মামলা বেড়েছে ১৪ হাজার ৪৫২টি এবং দাবির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। এর বিপরীতে দেশের বিভিন্ন ঋণখেলাপি থেকে ব্যাংগুলোর পাওনা টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি। তবে এত টাকা দাবির বিপরীতে ছয় মাসে আদায়ের পরিমাণ অতি নগণ্য। মাত্র ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।
বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কারণ ৪৩ হাজার ১৫৩টি মামলার বিপরীতে ৮৮ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা আটকে আছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৬০৪টি। এর বিপরীতে পাওনা টাকার পরিমাণ ৭১ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকারদের মতে, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় বেসরকারি ব্যাংক। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হার বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যায়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এসব ঋণ একসময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উল্টো চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ এখন বেসরকারি ব্যাংকেরই মামলা দাবির পরিমাণ বেশি।
ব্যাংকাররা আরও জানান, কুঋণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে।
এর কারণ হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও কুঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, ‘পর্যাপ্তসংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে। আবার আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নেন অনেক ঋণখেলাপি। এর ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় ব্যাংকের। পাশাপাশি নষ্ট হয় মূল্যবান সময়।’
তিনি বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়। যা আছে সেই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয় বলে মনে করেন তিনি।
অর্থঋণবিষয়ক বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী আদালতে মামলা করে ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ মামলা দায়ের করা না হলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে অর্থঋণ আদালত আইনে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার বাইরে যেসব অর্থঋণ আদালত আছে, সেখানে অর্থঋণ মামলার বাইরেও অন্যান্য মামলা পরিচালনা করে থাকেন অর্থঋণ আদালত। এতে অর্থঋণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। তা ছাড়া ব্যাংকগুলোকেও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ এ আইনজ্ঞের। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাতে নিয়মিত মামলার খোঁজ রাখেন সে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, অর্থঋণ আদালতের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু কিছু ব্যাংক মামলা করার পর আর কোনো খোঁজখবর রাখে না। বাদী ও আসামি উপস্থিত না থাকায় বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে মামলা। পরিবর্তন হতেই থাকে শুনানির তারিখ। ২০ বছর ধরে মামলার খবর না রাখার নজির পাওয়া গেছে এ বছর। এমন কাজ করেছে একাধিক বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ঘটনার পেছনে ব্যাংক ও গ্রাহকের জোগসাজশ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।