অনুসন্ধান
সোহেল চৌধুরী
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৩ ১১:০৮ এএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩ ১১:১০ এএম
দেশের খোলাবাজারে সর্বোচ্চ দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় গত ২৩ মার্চ- ২৭০ টাকা কেজি দরে। পরে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে নাটকীয়ভাবে তা প্রায় ১০০ টাকা কমে আসে। এতে বাজারে স্বস্তি নেমে এলেও সবখানে এই আলোচনা দানা বেঁধে ওঠে, কেন এই নাটকীয় দরপতন! কেননা, মাত্র তিন দিন আগেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় উৎপাদক বড় করপোরেটগুলো ব্রয়লার মুরগির দাম ১৯৫ টাকা কেজি দরে নামিয়ে আনতেই গড়িমসি করছিল। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিদিনের বাংলাদেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আসলে বৃহৎ চারটি কোম্পানির সিন্ডিকেটের কাছে বন্দি মুরগির বাজার।
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিদিনের বাংলাদেশ দেখেছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ডিম, মুরগীর বাচ্চা ও খাবারের দাম নিজেরাই নির্ধারণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই বা থাকলেও অনুসরণ করা হয় না।। প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, মনোপলির মাধ্যমে এর মধ্যে মাত্র ৫২ দিন বাজার থেকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তুলে নিয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকা। এজন্য প্রাণি সম্পদ অধিপ্তরের অবহেলা আর সেচ্ছাচারিতাকেও দায়ী করেন তারা।
উৎপাদন খরচের বিবরণ জমা দিতে নারাজ কোম্পানিগুলো
২০১০ সালে প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় পোলট্রি খাতসংক্রান্ত একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করেছিল। এই কমিটি ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর বৈঠক করে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ৫ ডিসেম্বর আরেকটি সভা আহ্বান করা হয়। সভায় উপস্থিত প্রান্তিক খামারিদের প্রতিনিধি জানান, বৈঠকটি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তখনকার পরিচালক প্রশাসন ও বর্তমান মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা ছাড়াও তৎকালীন পরিচালক (উৎপাদন) ও বর্তমান পরিচালক (প্রশাসন) মো. রেয়াজুল হক জসিম উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে মুরগীর বাচ্চা ও ফিডের উৎপাদন খরচ জানাতে সব পক্ষকে এক মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এই নির্দেশনা অনুযায়ী প্রান্তিক খামারিদের পক্ষ থেকে উৎপাদন খরচের বিবরণ জমা দেওয়া হয়েছিল। যদিও কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এখনও তা জমা দেয়নি।
এই প্রতিনিধি জানান, বিস্ময়কর হলো বৈঠকে কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘যদি স্থায়ী কমিটি থেকেই থাকে, তাহলে আবারও কমিটি গঠন করতে হবে কেন? যদি ২০১০ সালে উৎপাদন খরচ নির্ধারণে কমিটি গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে ২০২২ সালেও তা নির্ধারিত হয়নি কেন? এর অর্থ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তাতেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ নিতে নিতে পারছে।’
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বাজার বিশ্লেষক ও ভোক্তা কণ্ঠের সম্পাদক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দাম বাড়ানো হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দেখভাল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বেশ ভালোভাবেই করতে পারতো। কিন্তু সেটা তারা করেনি। প্রাণিসম্পদ আছে শুধু কিছু ট্রেইনিং আর প্রমোশনাল কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত। এ সংস্থাটির অবহেলায় বাজারে সেচ্ছাচারিতা চলছে। এতে সুযোগ নিচ্ছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশ, ৭১ ফিড, নারিশ পোল্ট্রি ফিড এন্ড হ্যাচারি, নাহার ইত্যাদি ১২টি বৃহৎ কোম্পানির মধ্যে কাজী ফার্মস, প্যারাগণ, ৭১ ফিড এবং নারিশ মনোপলির ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখছে।
খামারিদের বাধ্য করা হচ্ছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে
মনোপলির মাত্রা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রান্তিক খামারিদের রীতিমতো কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে বাধ্য করছে বড় করপোরেটগুলো। প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খামারিদের জন্য বাচ্চার দর সব সময়ের জন্য স্থির রেখেছেন ৩৫ টাকা। আর ফিডের বস্তার দাম একইভাবে স্থির রেখেছেন ২৬০০ টাকায়। অথচ প্রান্তিক খামারিরা একেকটি বাচ্চা কিনতে গুণতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে এক বস্তা ফিড কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৩৭৪০ টাকা। এতে চড়া মূল্য দিয়ে বাচ্চা ও ফিড কিনে মুরগি উৎপাদন করতে গিয়ে লোকসানে পড়ছেন প্রান্তিক খামারিরা। আবার প্রান্তিক খামারিদের মুরগি বাজারে আসা শুরু করলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে মুরগি বিক্রি করে। এতে বড় ধরণের লোকসানের মুখে পড়ে বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে খামারিরা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান বলছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে প্রান্তিক খামারিদের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে নেমেছে মাত্র ৬০ হাজারে। এরমধ্যে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য ১২ শতাংশ অর্থাৎ ১৯ হাজার চুক্তিবদ্ধ খামারি রয়েছে।
প্রান্তিক খামারিরা জানান, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে স্ট্যাম্পে চুক্তি করা হয়। এ ছাড়া খামারির দুটি ব্ল্যাংক চেক, জমির দলিলের ফটোকপিও নিয়ে নেওয়া হয়। লোকসান হলে খামারি টাকা পরিশোষে ব্যর্থ হলে ২০ হাজার টাকা পাওনার বিপরীতে ২০ লাখ টাকার মামলা করে করপোরেটগুলো। ৭১ ফিড আনুমানিক দুই থেকে চারশ মামলা করেছে খামারিদের নামে। শুধু তাই নয়, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে প্রতি কেজি মুরগিতে খামারিকে লাভ দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ টাকা। কিন্তু এর মধ্যে ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ এবং শ্রমের দাম খামারিকেই বহন করতে হয়। লোকসানের ভয়ে অনেক প্রান্তিক খামারি বাধ্য হয়েই এই দাসত্বের চক্তিতে যাচ্ছেন।
সংগঠনটির দাবি, দেশে প্রতিদিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ। এসব বাচ্চা কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। একেকটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। অথচ প্রতিটি বাচ্চা এখন ৬২ থেকে ৬৮ টাকায় দেওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। ফলে প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে করপোরেট কোম্পানিগুলো।
দায় এড়াচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
রহস্যজনক হলো, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গত ৫ ডিসেম্বর মুরগির বাচ্চা ও ফিডের দাম নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠন ও কৌশলপত্রের জন্য এক মাস সময় বেঁধে দিলেও এখন দায় চাপাতে চাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘাড়ে। সংস্থাটির মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, 'প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উৎপাদন কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত। দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এই অধিদপ্তরের ভূমিকা নেই। এটা পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজার নিয়ন্ত্রণও প্রাণিসম্পদ ওইভাবে করতে পারে না। এটার জন্য বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। আমরা এককভাবে কিছুই করতে পারব না।'
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দাম আসলে ব্যবসায়ীরাই নির্ধারণ করে। এটা আমাদের আয়ত্তে নাই। এটা ঠিক আমাদের ভূমিকা রাখা উচিত। আসলে অনেক কিছু করার আছে। কিন্তু করা যায় না।’
দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া ভূমিকার বিষয়ে জানতে কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিচালক ও বিড্রার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি কাজী জাহিনের সঙ্গে চেষ্টা চালিয়েও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এরপর তাকে হোয়াটসএ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠালে প্রতি-উত্তরে তিনি জানান, বর্তমানে তিনি ব্যাংকক অবস্থান করছেন, এসে জানাবেন।
এ প্রসঙ্গে বিড্রার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা দেবাশিস নাগ বলেন, 'বাচ্চা ও ফিডের দাম স্ব-স্ব কোম্পানির উৎপাদন খরচের ওপর নির্ধারণ করে থাকে। আমদানি ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়েই নির্ধারিত হয় দাম। একেক কোম্পানির বাচ্চা ও ফিডের দর আলাদা হয়ে থাকে। এখানে প্রতিটি কোম্পানি তার উৎপাদন খরচ অনুয়ায়ী দাম নির্ধারণ করে। তাই কোম্পানিভেদে বাচ্চা ও ফিডের দামও আলাদা হয়। এখানে সরকারি কোনো সংস্থার হস্তক্ষেপ বা নির্দেশনা নেই। মাকের্টের চাহিদার ওপরেই বাজার চলে।'
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন দাবি, সরকারি তদারকি না থাকায় এই খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই ৫২ দিনে মুরগি বিক্রি করে করপোরেট কোম্পানিগুলো লাভ করেছে ৬২৪ কোটি টাকা, আর একদিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে মুনাফা হয়েছে ৩১২ কোটি টাকা।
গত জানুয়ারিতে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। কিন্তু মার্চ মাসের ২৩ তারিখ তা উঠে ২৭০ টাকায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ তলব করে বৃহৎ চার প্রতিষ্ঠানকে। ভোক্তা অধিদপ্তরে এসে বৃহৎ চার প্রতিষ্ঠান- কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের খামার পর্যায়ে রমজানে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করবে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা দরে। তবে খামার পর্যায়ে এই দামে তিনদিন বিক্রি হলেও চতুর্থ দিনে মুরগি বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৬০ দরে। অভিযোগ রয়েছে, হঠাৎ দাম এতো কমে যাওয়ার মূল কারণ প্রান্তিক খামারিদের মুরগি খোলাবাজারে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠা। প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্যমূল্যে থেকে বঞ্চিত করতে ফার্ম পর্যায়ে বড় আকারে দরপতন করে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।