প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৮ পিএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:০৪ পিএম
প্রচণ্ড গরমে জমির বোরো ধান পুড়ে যাচ্ছে। পানি ও বিদ্যুতের অভাবে সেচ সংকটে পড়েছেন চাষিরা। প্রবা ফটো
সারা দেশে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে জমির বোরো ধান পুড়ে যাচ্ছে। পানি ও বিদ্যুতের অভাবে সেচ সংকটে পড়েছেন চাষিরা।
ক্ষেতের কোথাও কোথাও থোড়, কুশি এলেও গাছ না বেড়ে শুকিয়ে নুয়ে পড়ছে। কোথাও পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। এ ছাড়া তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির বেশি হলে ফসলের পরাগায়ন ঠিকমতো হবে না।
ইতোমধ্যে দেশের প্রায় সব জেলা ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে। কৃষকদের আশঙ্কা যদি ২-৩ দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত কিংবা বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে এবার ধানের ফলন বিপর্যয় হতে পারে। আমাদের প্রতিবেদকদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে-
বগুড়া : প্রচণ্ড গরমে জেলার অনেক জায়গার ধানে পচন ধরেছে। গাছে ধান আসতে সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেচ সংকটে ভুগছেন চাষিরা। এতে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে জেলাজুড়ে। বগুড়ার বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দাবদাহ মোকাবিলায় তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা আরও জানান, এবার ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। বোরো ধানের ক্ষেত্রে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই পরাগায়ন শুরু হয়। এ সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পরাগায়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধানও চিটা হয়ে যায়। তবে কোনো কারণে তাপমাত্রা বেশি হলেও গাছের গোড়ায় ২ থেকে আড়াই ইঞ্চি পানি সংরক্ষণ করলে ক্ষতি এড়ানো যায়।
ঈশ্বরদী : পাবনার ঈশ্বরদীতে এপ্রিলের শুরু থেকে তাপমাত্রা বেড়েছে, যা আরও কয়েক দিন অপরিবর্তিত থাকবে। এবার উপজেলার সাত ইউনিয়নেই কৃষকেরা বোরো ধানের আবাদ করেছেন। তারা জানান, গরমের কারণে শুধু ধান নয়, অন্যান্য ফসল, সবজি আবাদেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শাক-সবজি প্রচণ্ড গরমে মাটিতে হেলে পড়ছে। গাছ মরে যাচ্ছে, লাউয়ের ফুল এলেও তা শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি দিয়েও কাজ হচ্ছে না।
গত সোমবার উপজেলার ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগের দিনগুলো ৩৯, ৪০, ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠানামা করেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে চলতি বছর বোরো ধানের আবাদ রয়েছে।
ময়মনসিংহ : প্রচণ্ড গরম আর বিদ্যুতের অভাবে সবজি ও ধানসহ সব রকমের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বোরো ধানের জমিতে পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো জমিতে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এতে ধানে চিটার পরিমাণ বেড়ে যাবে বলে কৃষকদের আশঙ্কা।
জেলা কৃষি সম্প্রসাধরণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩ উপজেলায় এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৫০ হেক্টর। এসব উপজেলায় উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাতের বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে।
হালুয়াঘাট উপজেলার বিলডোরা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মোফাজ্জল জানান, ধারদেনা করে ১৫০ শতাংশ জমিতে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। ধানের ফলনও ভালো হয়েছিল। স্বপ্ন দেখেছিলেন সোনালি ফসলের। কিন্তু সেই স্বপ্নের ভাঁজ পড়েছে গত কয়েক দিনের দাবদাহ ও লোডশেডিংয়ে। এ ধরনের আক্ষেপ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের।
বর্তমানে মাঠে বোরো ধানে ফুল রয়েছে। কিছু আগাম জাতের ধানে রঙ ধরছে। কেউ কাটতে শুরু করেছেন। আবার কিছু ধান দুগ্ধজাত পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থায় তাপমাত্রার প্রভাব যদি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে যায়, ধানক্ষেতে পর্যাপ্ত পানি না দিতে পারলে চিটা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মৌলভীবাজার : চৈত্র মাস শেষ হয়ে বৈশাখ মাসের ৪-৫ দিন পেরিয়ে গেলেও প্রবল বৃষ্টিপাতের জন্য দেশব্যাপী পরিচিত এ জেলায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে একদিকে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা, অন্যদিকে সর্বনাশ হতে চলেছে জেলার কৃষি ও কৃষকের।
মৌলভীবাজার চা, লেবু, আনারস ও ধানের জেলা। জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে চা, লেবু, আনারসের অধিক ফলন হয় এবং হাওরাঞ্চল ও সমতলে ধানের ব্যাপক চাষাবাদ হয়ে থাকে। যে ফসল চাষ হোক না কেন সবক্ষেত্রে পানির বিকল্প নেই। পানির অভাবে ফসলের জমি ফেটে চৌচির। দাবদাহের কারণে ফসলের মাঠ অনেকটা জনশূন্য। তার ওপর ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগে ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার সিকিভাগে নেমে এসেছে। পানির সমস্যায় ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানায়, ব্লাস্ট রোগের কারণে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা আগেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ খরা বা তীব্র তাপপ্রবাহে পানির অভাবে অনেক গ্রামাঞ্চলে ধানের ফুল শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর এলাকার বাংলা পানের বরজ তাপপ্রবাহে নষ্ট হয়েছে।
ফরিদপুর : তীব্র দাবদাহে ফরিদপুর জেলার কৃষিক্ষেতে বড় আকারের ক্ষতির আশঙ্কা দেখছে দিয়েছে। খরায় শুকিয়ে চৌচির হচ্ছে ফসলি ক্ষেত। গত এক সপ্তাহে দুইবার ক্ষেতে সেচ দিয়েও রক্ষা করা যাচ্ছে না ফসল। এরই মধ্যে পোকা ধরেছে পাটের পাতায়, অতিতাপে নুয়ে পড়ছে ধানের ছড়া। আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে অধিক তাপে সবুজ ধানের ছড়া হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে এসব ধানের ছড়ায় চিটা ধরতে শুরু করবে।
জেলার নগরকান্দা উপজেলার ডাঙ্গী ইউনিয়নের কৃষক রওশন আলী বলেন, কেবল ধানের বাইল (ছড়া) ছেড়েছে, আগামী জুন মাসে ধান কাটা হবে। এই গরমে ধানের বাইলগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে ভাইরাস। স্থানীয় ভাষায় এর নাম ‘কারেন্ট পোকা’। এদিকে বাড়ির সাধারণ নলকূপেও পানি কম উঠছে বলে তিনি জানান।
নওগাঁ : নওগাঁয় তীব্র দাবদাহে বোরো আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ঝরে পড়ছে এলাকার সব আমগাছের গুটি। পুকুর, নদী, খাল-বিল, মাটির কূপের পানি শুকিয়ে গেছে। তীব্র দাবদাহে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। গত এক সপ্তাহের মধ্যে জেলার তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে এলেও ঘরের বাইরে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি চেয়ে নামাজ আদায় করছেন সাধারণ মানুষ।
জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের পোরশা উপজেলা সদরের বাসিন্দা ডিএম রাশেদ জানান, তার বাড়ির অতিপ্রাচীন মাটির কূপটি এই প্রথম শুকিয়ে গেছে। ওই কূপ থেকে খাবার পানিসহ সাংসারিক কাজকর্ম চলত। ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদীগুন গ্রামের কৃষক আফজাল মণ্ডল বলেন, আগে পানি সেচ দিয়ে বোরো আবাদ করেছি। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে শ্যালো মেশিনের পাম্পে আর পানি উঠছে না। অন্যদিকে, আমচাষিরাও বেকায়দায় রয়েছেন। আমেরও ফলন বির্পযয় হতে পারে বলে আমচাষিরা দাবি করেছেন।