তৈরি পোশাক রপ্তানি
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:০৮ এএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১০:৪৯ এএম
প্রতীকী ছবি
অর্থ পাচারের লক্ষ্যে একটি গেঞ্জির ওজন দেখানো হয়েছে এক কেজি বা তারও বেশি। জালিয়াতি করা হয়েছে ব্যাংকের নথিপত্র। চট্টগ্রামের কয়েকটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে অভিনব কৌশলে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে তৈরি পোশাক খাতের ১০টি প্রতিষ্ঠান। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এই তথ্য মিলেছে।
অর্থ পাচারের প্রমাণ মেলার পর সংশ্লিষ্ট ১০ প্রতিষ্ঠানের বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) স্থগিত করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও ফৌজদারি আইনে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে সংস্থাটি। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. বশির আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব, সুদান, নাইজেরিয়া, টোঙ্গা, পানামা, ব্রুনাই ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি দেখিয়ে এসব অর্থ পাচার করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑ প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, পিক্সি নিট ওয়্যারস, হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমডিএস ফ্যাশন, থ্রি স্ট্রার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, স্টাইলজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার এবং জালিয়াতির সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রায় ১০টি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টেরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অভিনব কৌশলে রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য বিদেশে রপ্তানি হলেও বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনা হচ্ছে না। এমন তথ্য পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দার কর্মকর্তারা অভিযান শুরু করেন। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি করে অপর রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানির প্রমাণ মেলে। তারা বিল অব এক্সপোর্টের কলামও পরিবর্তন করে ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানির অর্থ দেশে ফেরত না এনে পুরো টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
তদন্তে দেখা যায়, ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মোট ১ হাজার ২৩৪টি পণ্য চালানে জালিয়াতি করেছে। রপ্তানি সম্পন্ন করা ১ হাজার ২৩৪টি চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন। এর সম্ভাব্য দাম বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৮ মার্কিন ডলার বা ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট, প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে টি-শার্ট রপ্তানি দেখানো হয়েছে বেশি। জালিয়াতির জন্য প্রতিটি টি-শার্টের ওজন দেখানো হয়েছে এক কেজি পর্যন্ত।
১০ প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্ট ও ইএক্সপিতে (রপ্তানিকারকের ঘোষণাপত্র) বর্ণিত তথ্যের মধ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত ব্যাংক ছিল সাউথ ইস্ট ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই ওই ব্যাংকে লিয়েন করা ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে সাউথইস্ট ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে এই ব্যাংকের মাধ্যমে বিল অব এক্সপোর্টে উল্লেখ করা সেলস কন্ট্রাক্ট ও ইএক্সপিতে উল্লেখ করা রপ্তানি মূল্য ফেরত আসেনি বা আসার কোনো সুযোগ নেই।
প্রজ্ঞা ফ্যাশন
সাভারের আশুলিয়ার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৩৯১টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। তাদের রপ্তানি করা পণ্যের চালানগুলোতে ৩ হাজার ৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানির ঘোষণা রয়েছে। রপ্তানি করা পণ্যের দাম প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার বা ৯২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের দেওয়ান হাট এলাকার এমএজে শিপিং করপোরেশন খাতুনগঞ্জের রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, আগ্রাবাদের এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সুগন্ধা এলাকার জেজে অ্যাসোসিয়েটস ও বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার এক্সপ্রেস ফরোয়ার্ডারস।
ফ্যাশন ট্রেড
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ঢাকার গুলশান এলাকায়। তারা ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬টি, ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ মোট ২৪৬ রপ্তানি চালান জালিয়াতি করেছে। রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে ১ হাজার ৭৭৯ টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা জাতীয় তৈরি পোশাক সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করে। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ ডলার বা ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের এমএজে শিপিং করপোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল ও এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
এমডিএস ফ্যাশন
ফ্যাশন ঢাকার উত্তরার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমডিএস। তারা ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানি চালান জালিয়াতি করে। তারা মোট ১ হাজার ৩৭৬ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার ও ফিলিপাইনে রপ্তানি করে। রপ্তানিকৃত পণ্যের দাম প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ ডলার বা ৪৪ কোটি ১৫৫১ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জিআর ট্রেডিং করপোরেশন ও পান বেঙ্গল এজেন্সি।
হংকং ফ্যাশন লিমিটেড
এটি গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে ১৫৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে। তাদের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এমএজে শিপিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, পরাগ এসএমএস লিমিটেড, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স এ কে এন্টারপ্রাইজ।
থ্রি স্টার ট্রেডিং
ঢাকার বনানীর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এটি। তারা ২০২০ সালে ১২০টি রপ্তানি চালানে ৮১৬ টন টি-শার্ট মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কানাডা ও মিসরে রপ্তানি করে। তাদের রপ্তানি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জিআর ট্রেডিং করপোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, কেআরএস সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেড ও এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
ফরচুন ফ্যাশন
ঢাকার মিরপুরের ফরচুন ফ্যাশন ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৫৯টি রপ্তানি চালানে ৪৩৫ টন টি-শার্ট রপ্তানি করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মিসর, কানাডায়। তাদের অর্থ পাচারে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ও এম/এসএকে এন্টারপ্রাইজ।
অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড
ঢাকার কচুক্ষেত এলাকার অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে ১৯৫ টন টি-শার্ট আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করে। তারা মোট ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ ডলার বা ৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০৩ টাকা পাচার করেছে। এই জালিয়াতিতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পান বেঙ্গল এজেন্সি, এএন্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জেজে অ্যাসোসিয়েট, জিআর ট্রেডিং করপোরেশন ও এনএইচ করপোরেশনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
পিক্সি নিট ওয়্যারস
গাজীপুরে টঙ্গী এলাকার পিক্সি নিট ওয়্যারস ২০২০ সালে ২০টি রপ্তানি চালানে ১৭০ টন টি-শার্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি করে। এসব পণ্য রপ্তানি করে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ ডলার বা ৫ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা পাচার করেছে।
স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড
ঢাকার শাহবাগের স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানি চালানে ৬৬ দশমিক ৮ টন টি-শার্ট ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া ও পানামায় রপ্তানি করে। তারা ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ ডলার বা ২ কোটি ১৭ লাখ ২ হাজার ৯০২ টাকা পাচার করেছে।
ইডেন স্টাইল টেক্স
ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার ইডেন স্টাইল টেক্স ২০২০ সালে ৮টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করে ৪২ টন টি-শার্ট টোঙ্গা, ওমান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি করে। এর মাধ্যমে তারা প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ ডলার বা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা পাচার করেছে।