জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৩০ এএম
আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৫১ পিএম
নিজেদের আর্থিক প্রতিবেদনে উন্নতি দেখাতে খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য গোপন করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। শুধু তা-ই নয়, এসব ঋণের বড় অংশই পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
২০২২ সালের ৩০ জুনভিত্তিক ওই পরিদর্শনে পাওয়া যায় ৩৭৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছে বিকেবি। ১ হাজার ৩৮টি শাখার মধ্যে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ ৩৭টি শাখা পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি শাখাগুলো পরিদর্শনে আরও অসঙ্গতি উঠে আসবে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে বিকেবির প্রকৃত খেলাপির ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি ৭৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করে ২ হাজার ৬২৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ঋণ বিতরণ করে সেই ঋণ আদায়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না বিকেবি। কারণ আগের বছরের তুলনায় পরিদর্শনের সময় ব্যাংকটির ৫৯৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি ব্যাংকগুলোকে তাদের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে আনতে মরিয়া। এ কারণেই ব্যাংকগুলোতে তথ্য গোপন এবং বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলের ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অনেক সময় বিভিন্ন কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য পাঠাতে দেরি বা তথ্যে গরমিল হয়। তবে এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। তথ্যের গরমিল দ্রুতই সমন্বয় হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অনিয়মের বিষয়গুলো উঠে এসেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৮৩৯তম পর্ষদ সভায়। যে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২২ আগস্ট। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিষদ পরিদর্শন প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ৩০ আগস্ট ৮৪০তম সভায় সেই পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকাশিত ব্যাংকের ত্রুটি ও তা সংশোধনে করণীয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
তথ্যমতে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণকৃত মোট ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ২৯০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৪০ কোটি ৫৩ লাখ। অর্থাৎ মোট বিতরণের ৬৩ দশমিক ৬১ শতাংশই কৃষি ও এসএমই খাতে বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো, এসব ঋণের বড় অংশই পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হয়েছে। সুতরাং কৃষি ও এসএমই খাতের বরাত দিয়ে নেওয়া এসব ঋণ ভিন্ন খাতে ব্যবহার হয়েছে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ঋণগুলো আদায় না হয়ে বারবার পুনঃতফসিল কেন করতে হচ্ছে, তার জবাব চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ।
ব্যাংকটির পরিস্থিতি বিবেচনায় দিন দিন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ বিতরণ ও শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে আশানুরূপ আদায় হচ্ছে না, যা সম্পদের তুলনায় মূলধন ক্ষয় ও আমানতের অংশ ক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ব্যাংকটির সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল ও বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃতফসিলের কোনো সুযোগ নেই। এরপর পুনঃতফসিল করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাকের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেই বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক মেসার্স পদ্মা ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেডের একটি ঋণ পাঁচবার পুনঃতফসিল করেছে। শুধু তা-ই নয়, মেসার্স সাদ মুসা ফেব্রিক্সের ডাউন পেমেন্ট যথাসময়ে না পাওয়ার পরও পুনঃতফসিল করা হয়েছে।
এছাড়া মেসার্স আলিফ অ্যাগ্রো লিমিটেডের পুনঃতফসিল করা ঋণ, শীর্ষ ২০ খেলাপি ও অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলা থেকে আদায়ের কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিদর্শন দলের মতে, ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ এবং সেই বিবেচনায় আদায় কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়।
পুনঃতফসিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেবি ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৃহৎ স্বার্থে অনেক সময় গ্রাহককে ছাড় দিতে হয়। কারণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে তারা কিছুটা সময় পায়। ব্যবসা করে আবার ঋণ ফেরত দেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু তা না করলে ঋণগুলো আদায়প্রক্রিয়া আরও মন্থর হয়ে পড়ে। যারা পুরোনো গ্রাহক, ব্যাংকের স্বার্থেই দুর্দিনে তাদের সহযোগিতা করে সব ব্যাংক। আমরাও সেটাই করেছি।
বিস্বস্ত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামভিত্তিক সাদ মুসা গ্রুপকে আইন লঙ্ঘন করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে বিকেবি। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পরিচালনা পর্ষদের ৬৯৭তম সভায় মেসার্স সাদ মুসা ফেব্রিক্স ফিমিটেডকে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা অনুমোদন করা হয়। কিন্তু শর্ত ছিল মোট ৫ কোটি টাকার অবশিষ্ট ডাউনপেমেন্ট ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ২০১৮ সালের ২১ মার্চের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সেই শর্ত পরিপালন করেনি সাদ মুসা। ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর ব্যাংকের ৭৪৭তম পর্ষদে সুদ মওকুফ করে ঋণটি আবারও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। বর্তমানে ঋণটি নিয়মিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানান, বিভিন্ন ব্যাংকে পরিদর্শন কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাছাড়া এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নিয়মিত কাজের অংশ। যদি কোনো ব্যাংক আইনের ব্যত্যয় ঘটায়, তাহলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোন অপরাধের সাজা কী রকম, তা সেই আইনেই নির্ধারণ করা আছে।