× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দেউলিয়া নয়, পছন্দ অর্থঋণ আদালত

জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৩৭ এএম

আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:২৬ পিএম

দেউলিয়া নয়, পছন্দ অর্থঋণ আদালত

‘স্বভাবগত’ খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের একটি প্রক্রিয়ার নাম দেউলিয়া আইনে মামলা। যদিও প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি, কিন্তু অন্যান্য প্রক্রিয়া বা আইনের চেয়ে শক্ত। সংশ্লিষ্টদের মতে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের অবৈধ সুবিধা না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আইনে মামলা করা উচিত। কারণ, তাদের মূল লক্ষ্যই থাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা। এ রকম অসাধু ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিকল্প নেই।

দেউলিয়া আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতে মামলা করতে পারে, আবার ব্যাংকও চাইলে খেলাপি গ্রাহককে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য মামলা করতে পারে। এক্ষেত্রে দেউলিয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে অর্থ আদায়ে এর বাইরে তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না ব্যাংক বা পাওনাদার প্রতিষ্ঠানের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৯৭ সালে দেউলিয়াবিষয়ক আইন প্রণয়ন হয়। এরপর থেকে দেউলিয়া আদালতে মামলা হয়েছে মোট ৫৩৩টি। যেখানে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এসব মামলার মধ্যে ৩৬১টির নিষ্পত্তি হয়েছে। যেগুলোর মোট দাবিকৃত টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৩৩২ কোটি ৬৪ লাখ হলেও প্রকৃত আদায়ের পরিমাণ ৪১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের প্রায় ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকাই আটকে আছে দেউলিয়া আদালতের মামলায়।

আইন অনুযায়ী দেউলিয়া আদালতে মামলা করার পর আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে সংশ্লিষ্ট খেলাপির সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে রিসিভার নিয়োগ দেন। এরপর প্রতিবেদন পাওয়ার পর আদালত খেলাপির সম্পত্তি ক্রোক করে ব্যাংকের অনুকূলে নেওয়ার রায় দেন। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে ঋণগ্রহীতাকে অর্থ পরিশোধ করার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার ব্যত্যয় ঘটলে ওই রায় দেউলিয়া আদালতে পাঠানোর বিধান রয়েছে।

প্রসঙ্গত, কোনো গ্রাহককে দেউলিয়া ঘোষণা করা হলে ব্যাংকে জামানত হিসেবে রাখা সম্পদের বাইরে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায়ের বিধান রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর কোনো সম্পদ বিক্রি বা আত্মীয়-স্বজনকে দান করা হলে তাও বাতিল করার সুযোগ রয়েছে দেউলিয়া আইনে। যদি গ্রাহক প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সম্পদের তথ্য গোপন করে, তাহলে যে ব্যক্তি ওই সম্পদের খবর দিতে পারবে, তার জন্য রয়েছে পুরস্কারের ব্যবস্থাও। ব্যাংকের গ্রাহক পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে না পারলে সে ভোটাধিকার প্রয়োগের যোগ্যতা হারাবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এবং অর্থদণ্ডসহ সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে সমস্যার বিষয় হচ্ছেÑ দেশে দেউলিয়া আদালত মাত্র দুটি। একটি ঢাকায়, অন্যটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে দক্ষ আইনজীবী ও পর্যাপ্ত রিসিভার বা সমন্বয়কের অভাব রয়েছে। রিসিভারদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারা হবে তারও কোনো বর্ণনা নেই দেউলিয়া আইনে।

রূপালী ব্যাংকের আইন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে রাজধানীর পুরানা পল্টন শাখার এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আদালতে মামলা করে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটি। ওই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের নাম শন ফ্যাশন প্রপার্টি লিমিটেড। তিন বছরের মাথায় আদালতের আদেশে বন্ধকী ও অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে সাড়ে ৭ লাখ টাকা আদায় করতে সক্ষম হয় ব্যাংক। তবে এক্ষেত্রে সুদের টাকা মওকুফ করা হয় বলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। একই ব্যাংকের চট্টগ্রাম মাঝিরঘাট শাখার গ্রাহক ছিল এমএস সালাম ট্রেড করপোরেশন। একই মালিকের আরেক প্রতিষ্ঠান প্যারাগন লেদার অ্যান্ড ফ্যাশন লিমিটেড। দুই প্রতিষ্ঠানের মোট দেনা ছিল ১৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। বহুদিন খেলাপি হয়ে পড়ে থাকার পর ব্যাংকের মামলার ভিত্তিতে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠান দুটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন আদালত। মালিককে দেওয়া হয় দুই বছরের কারাদণ্ড। তবে তার কাছ থেকে কোনো টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেউলিয়া আদালতে বিচারাধীন মামলার পরিমাণ ১৭২টি। এসব মামলায় দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ৪২৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যার মধ্যে প্রকৃত আদায় মাত্র ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ জুন শেষে দেউলিয়া আদালতের বিচারাধীন মামলায় আটকে আছে ৪২২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। দেউলিয়া আদালতের এসব মামলার বেশিরভাগই করেছে ব্যাংক বা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের করা মামলাগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশই হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।

আইনজীবীরা বলছেন, ব্যাংক যখন কোনো ব্যক্তিকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য মামলা করে, তখনই বিপত্তি বাধে। দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ঋণখেলাপি নানা অজুহাত দেখিয়ে হাইকোর্টে রিট করে মামলা স্থগিত করে নেয়। খেলাপির হাত থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করতে প্রায় ৬ বছর আগে দেউলিয়া আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইনটির সংস্কার এখনও ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। এটি পাস হওয়ার পর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যক্তি ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হলে নিজ নামে অনেক সুবিধাই আর ভোগ করতে পারবে না। নতুন আইনে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দ বা বাতিল করা হবে। আমন্ত্রণ জানানো হবে না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। কোম্পানির পরিচালক কিংবা ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ, এমনকি গাড়ি কেনায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।

আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় দেউলিয়া আদালতে অনেক মামলা দায়ের হতো। দেখা গেছে, দেউলিয়া প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খেলাপি ঋণের টাকা ওঠানো সম্ভব হয় না। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংক অধিকাংশ সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকে ব্যাংকগুলো সম্পত্তি মর্টগেজ নেওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সিকিউরিটি চেক নেয়। ফলে খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার পাশাপাশি এনআই অ্যাক্টেও মামলা করে ব্যাংক। অর্থঋণে মামলা চলাকালীন কোনো খেলাপি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার মামলা করলে অর্থঋণের মামলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। অনেক খেলাপি এই অপকৌশল অবলম্বন করত। তবে এর সংখ্যা এখন কমে এসেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অসচেতনতার কারণেই মনে হয় দেউলিয়া আদালতে মামলা হচ্ছে না। সব ব্যাংকের কাছে দেউলিয়া আদালতে মামলার ধারণাটা পরিষ্কার নয়। নিয়মের কারণেই হয়তো অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। তবে দেউলিয়া আইনের প্রচার ও যথাযথ প্রয়োগ দরকার।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, দেউলিয়া আদালতে না যাওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। আগে থেকেই আর্থিক সুশাসনের অভাব। তা ছাড়া আদালতের কার্যক্রমও গতিহীন। তাই একেকটি মামলা দীর্ঘদিন ফাইলচাপা হয়ে পড়ে থাকে। ব্যাংকও সব সময় দাবিকৃত টাকার পুরোটা ফেরত পায় না। কারণ, জামানত রাখা সম্পদের মূল্য ঋণস্থিতির চেয়ে কম থাকে। এসব সমস্যা সমাধানে সুশাসন ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা