× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শীত-কুয়াশায় ‘আহত’ বীজতলা, আলুক্ষেত

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:৩৯ এএম

আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:০১ পিএম

শীত-কুয়াশায় ‘আহত’ বীজতলা, আলুক্ষেত

জানুয়ারির মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশের ওপর দিয়ে দুটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। কিছু এলাকায় আবার শীতকালীন বৃষ্টিও হয়েছে। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি ক্ষতি হয়েছে নানারকম ফল-ফসলের। বিশেষ করে আলুতে দেখা দিয়েছে মড়ক। এ ছাড়া বর্তমানে দাম বেশি পাওয়ায় অনেক কৃষকই অপরিপক্ব আলু তুলে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই প্রবণতায় এবার আলুর উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে সামনের দিনগুলোতে আলুর সংকট দেখা দিতে পারে, বাড়তে পারে আমদানি নির্ভরতা। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর দেশে সাড়ে ৪ লাখ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ কোটি ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে উচ্চ ফলনশীল আলু চাষ হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে। স্থানীয় আলু চাষ হয়েছে ৫৬ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া ১ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে পেঁয়াজ। সবজি চাষ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে।

বর্তমানে মাঠে রয়েছে রবিশস্য। সাধারণত এ সময় গম, ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ও শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের ডাল ও তেলবীজেরও উৎপাদন হয়ে থাকে। বিশেষ করে বোরোর বীজতলা তৈরি ও রোপণের কাজ চলে এ মৌসুমে। অসময়ের বৃষ্টি ও ঘন কুয়াশায় ফসলে পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। কোল্ড ইনজুরিতে ধানের বীজতলা, আলু ক্ষেত রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেক এলাকায়।

প্রসঙ্গত, গত ২ থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দিনাজপুরের সৈয়দপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল এবং ১৩ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। আবার ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। এতে সেখানকার মাঠে থাকা কিছু কিছু ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

ঘন কুয়াশায় আলুর ব্যাপক ক্ষতি

কয়েক দিন ধরে একটানা তীব্র শীতের প্রকোপ আর ঘন কুয়াশায় নওগাঁয় বোরো বীজতলা এবং আলুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে একদিকে বোরো ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা, অন্যদিকে আলুর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। 

স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় মোট ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। বছরের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ঘন কুয়াশায় কোনো কোনো জমিতে আলুর পাতা, ডাল ও গাছ মরে যেতে শুরু করেছে। কৃষকরা প্রায় প্রতিদিন কীটনাশক প্রয়োগ করলেও লাভ হচ্ছে না। কৃষি বিভাগের পরামর্শও তারা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এসব জমিতে প্রতি বিঘায় ৬০ থেকে ৮০ মণ হারে আলু উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ বছর বিঘাপ্রতি ফলন ৫ থেকে ৬ মণ হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ কৃষকদের বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ হয়েছে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা।

ঘন কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে বিপাকে পড়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের আলুচাষিরা। জেলার আখানগর ইউনিয়নের আলুচাষি খাদেমুল ইসলাম জানান, তিনি ২ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। ক্ষেতের গাছগুলো কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। একই এলাকার কৃষক খুরশেদ আলম জানান, তিনি ৪ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। এবার আলুবীজের দাম ছিল গতবারের চেয়ে প্রায় দুই গুণ বেশি। কুয়াশার কারণে আলু গাছে তেমন ফল নেই। 

মুন্সীগঞ্জের আলুচাষি আফসার উদ্দিন বলেন, ডিসেম্বরে যখন আলু রোপণ করেছি তখন একবার বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে যায়। পরে আবার রোপণ করেছি। ৪ বিঘা জমিতে খরচ পড়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। কুয়াশা ও শীতের কারণে কিছু আলু গাছ মরে গেছে। ফলে আলু তুলে বিক্রি করছি। 

নারায়ণগঞ্জের আবুল হোসেন জানান, তাদের অঞ্চলে শিমের ছড়া থেকে শিম ঝরে পড়ছে। প্রতিটি ক্ষেতেই এ অবস্থা। যে ছড়ায় ১৫ থেকে ২০টি শিম ছিল, সেখানে টিকে থাকছে মাত্র ২/৩টি।

বোরো বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তা 

যশোরে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশা থেকে রক্ষায় রাতে বোরো ধানের বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখছেন কৃষকরা। এ জেলায় সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। এলাকার কৃষক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক দিনের কুয়াশায় ধানের চারা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় রাতের বেলায় পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখছি।’ জেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে। কৃষকরা ১০ হাজার ৬৯৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করেছে।

ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কৃষকরা। বেশ কয়েক দিন ধরে সূর্যের আলো ঠিকমতো না পাওয়ায় বোরোর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। উপজেলার কৈডাঙ্গা গ্রামের কৃষক বেলাল হোসেন জানান, প্রায় ৪ বিঘা জমিতে তিনি বীজতলা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে নিজের ৩ বিঘা জমিতে চারা রোপণ করবেন। বাকি চারা বাজারে বিক্রি করবেন। তীব্র শীত আর কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাড়তি পরিচর্যা করতে গিয়ে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৫ পরামর্শ

শীত ও কুয়াশা থেকে বোরো ধান ও রবিশস্য রক্ষায় কৃষি মন্ত্রণালয় ৫টি পরামর্শ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছেÑ এক. কুয়াশা ও মৃদু বা তীব্র শীতের এ অবস্থায় বোরো ধানের বীজতলায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখতে হবে। দুই. ঠান্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বীজতলা রাতে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, বীজতলা থেকে পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিতে হবে এবং প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমা শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে। তিন. আবহাওয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে আলুর নাবিধসা রোগের আক্রমণ হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় ম্যানকোজেব গোত্রের ছত্রাকনাশক ৭ থেকে ১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। চার. সরিষায় অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ দেখা দিতে পারে। রোগ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদিত মাত্রায় ইপ্রোডিয়ন গোত্রের ছত্রাকনাশক ১০ থেকে ১২ দিন পরপর তিন থেকে চারবার স্প্রে করতে হবে। পাঁচ. ফল গাছে নিয়মিত হালকা সেচ দিতে হবে। কচি ফল গাছ ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষার জন্য খড় বা পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

কুয়াশার কারণে কৃষি ফসলের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা বেশি থাকলে ধানের চারার বৃদ্ধি ঘটে না বরং চারা মরে যায়। শাক-সবজির ক্ষতি হয়। বিশেষ করে বেশি কুয়াশা পড়লে আলু ক্ষেত লেট ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়। এতে পাতা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাতে ফলন কমে যায়। শীতের তীব্রতা বেশি থাকলে ধান রোপণ করা যাবে না।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ঘন কুয়াশা, তীব্র শীত, বৃষ্টিপাত, সূর্যালোক না থাকা এবং আর্দ্রতা বেশির কারণে এ বছর ফসলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেশি হয়েছে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হলেও আর্দ্রতা বেশি থাকলে ও বৃষ্টিপাত হলে রোগবালাই বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় আলুতে মড়ক ছড়িয়ে পড়ছে। এ রোগের সংক্রমণ ঘটলে কয়েক দিনের মধ্যেই জমি শেষ হয়ে যায়। ফলে কৃষকরা আগাম আলু তুলে ফেলছেন। এসব আলু পরিপক্ব হওয়ার আগেই তুলে ফেলার কারণে এক থেকে দুই মাসের বেশি সময় সংরক্ষণ করতে পারবেন না। পরিপক্ব আলু এক কেজিতে যেখানে ১০ থেকে ১২টি উঠত সেখানে এসব অপরিপক্ব আলু উঠছে ১৮ থেকে ২০টি। কৃষক দাম বেশি পাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এটি আমাগীতে চাহিদা অনুযায়ী আলুর জোগান দিতে পারবে না। ফলে আলু আমদানি বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, এক কৃষক জানিয়েছেন যেখানে এক শতকে ৩ মণ আলু উৎপাদন হতো সেখানে আগাম তোলার কারণে ফলন হয়েছে ২ মণ। তবে দাম বেশি পেয়েছে ২-৩ গুণ। আগাম আলু তুলে কৃষক লাভবান হলেও সামগ্রিক উৎপাদন কমে যাবে। আবার তীব্র শীতে উপকারী পোকা ও মৌমাছির চলাচল কমে যাওয়ায় পরাগায়নে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ফলে পরপরাগী ফসলের উৎপাদন কমে যেতে পারে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিবেদকরা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা