× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মূল্যস্ফীতির বড় আঘাত নারী-শিশুদের ওপর

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৬ এএম

আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৫৩ এএম

মূল্যস্ফীতির বড় আঘাত নারী-শিশুদের ওপর

টানা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত প্রায় দুই বছর মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে। এমন পরিস্থিতিতে খরচ কমিয়েও সামলানো যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির ধাক্কা। এ পরিস্থিতিতে কম খেয়ে টিকে থাকার পথ বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর এর প্রধান আঘাত পড়েছে নারী ও শিশুদের ওপর। শিশুদের সুষম বিকাশের জন্য প্রয়োজন বাড়তি খাবার ও পুষ্টি। সেটিও কাটছাঁট করতে; অনেক ক্ষেত্রে বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। কিশোর-কিশোরী ও নারীদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন ফাহমিদা বেগম। তিনি বলছিলেন, ‘ছোটখাটো খরচ কমিয়েও আর বাজারের ব্যয় মেটাতে পারছি না। অতিথি আপ্যায়নও কমিয়ে দিয়েছি। তা-ও কুলাচ্ছে না।’ 

পরিবারে খাবারের দিকটা মূলত তাকেই দেখতে হয় বলে জানালেন ফাহমিদা। তিনি বলেন, ‘সন্তানদের জায়গা ঠিক রেখে তারপর নিজেদের কথা ভাবি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে বাজার করতে গিয়ে বাচ্চাদের পুষ্টির দিকে আর নজর রাখতে পারছি না।’

ফাহমিদা বেগমের মতো অনেক মধ্য ও নিম্নবিত্ত নারীই এখন নিজের পাতের পুষ্টিকর খাবার পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি, শিক্ষার্থী সন্তান ও শিশুর পাতে তুলে দিয়ে চেষ্টা করছেন তাদের পুষ্টির চাহিদা ঠিক রাখতে। নিজেকে পুষ্টি বঞ্চিত করছেন। পরিস্থিতি সামলাতে কেউ স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কম ভাড়ার ছোট বাসায় উঠছেন। এরপরও যখন ব্যয় সংকুলান করতে পারছেন না, তখন হাত দিচ্ছেন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। আমিষসমৃদ্ধ পণ্যসহ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এমনকি ডিমকেও রাখতে হচ্ছে তালিকার বাইরে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির ঘাটতি আরও বাড়ছে। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে অনেক শিশু ও প্রসূতি মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৩০ দশমিক ২ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মূল্যস্ফীতির কারণে অপুষ্টিজনিত এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে। কারণ দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গত বছরের নভেম্বরে সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত নভেম্বর পর্যন্ত ছিল ৯ শতাংশের বেশি। অবশ্য বিবিএসের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা খানিকটা কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু নিত্যপণ্য মূল্যের দ্রুত উত্থান-পতনের কারণে এর প্রভাব খাদ্যবাজারে তেমন দৃশ্যমান নয়।

গত বছর প্রকাশিত ‘শিশুর অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শিরোনামের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, বাংলাদেশের পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৬ শতাংশ শিশুই পুষ্টির অভাবে খর্বকায় হয়ে পড়েছে। দেশে এমন শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। এ ছাড়া দুই বছরেরও কম বয়সি ২ কোটি ৩০ লাখ শিশুর মধ্যে খর্বাকৃতির সমস্যা ক্রমবর্ধমান। 

আর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি)-এর তথ্যমতে, দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কমবেশি অব্যাহত থাকলে শিশুদের পুষ্টি সমস্যা আরও বাড়বে।

টিফিন বক্সে কাটছাঁট

দোকানে প্যান্ট দেখছিলেন তানজিনা আক্তার। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল স্কুলজামা পরা রাইসা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ জানালেন তানজিনা, টিফিনে আগের মতো ভালো কিছুই দিতে চাই। কিন্তু এখন এমনও হয় যে, বিস্কুট দিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটা স্কুলে পড়ে। ওর স্কুলের বেতন কি কমাতে পারব? বাসাভাড়াও তো কম দেওয়া যাবে না। তাই টান পড়ছে টিফিন বক্সে। দুই ছেলেমেয়েকে এখন ডিম দিলে ভাগ করে দিই। দুধটাও দুজনকে আগের মতো না দিয়ে ভাগ করে দিই। যদি বাচ্চাদেরই ভাগ করে দিতে হয়, তাহলে বোঝেন, মা-বাবার অবস্থা কী!’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন জানালেন, ‘বাড়ন্ত বয়সের বাচ্চাদের বৃদ্ধির জন্য প্ল্যান্ট প্রোটিন (উদ্ভিজ আমিষ) পর্যাপ্ত না। বাচ্চাকে অ্যানিমেল প্রোটিন (প্রাণিজ আমিষ) খেতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষ ভাত বেশি খায়। তাই তাদের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদার অনেকটাই এখান থেকে পূরণ হয়। কিন্তু তারা কি মানসম্পন্ন প্রোটিন খাচ্ছে? কারণ প্রাণিজ আমিষ ও উদ্ভিজ আমিষ দুটোই প্রয়োজন। উদ্ভিজ্জ আমিষ দিয়ে প্রাণিজ প্রোটিনের অপরিহার্য মাত্রাটি পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ প্রাণিজ প্রোটিনের ক্ষেত্রে যে ২০টি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে প্রোটিন তৈরি হচ্ছে, গ্রোথের জন্য সেটির গুরুত্ব অন্যরকম। প্রতি কেজি ওজনের জন্য দশমিক ৮ গ্রাম প্রোটিন দরকার। তার মধ্যে ৩০ শতাংশ অবশ্যই প্রাণিজ প্রোটিন থাকতে হবে।

দুরবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা নারী

অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘গর্ভবতী নারীর স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি খাবার প্রয়োজন হয়। না হলে শিশুর ওজনও কম হতে পারে। এই সময় নারীদের অবশ্যই মাছ অথবা মাংস খেতে হবে। না হলে অন্য কোনো প্রাণিজ প্রোটিন খেতে হবে। সেটা ডিমও হতে পারে। কিন্তু প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।’

রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা তিশা আক্তার ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তবে ভয়ের কথা হলো, এই সময় তার ওজন যতটা হওয়ার কথা, ততটা হয়নি। তিশা ও তার স্বামী একরামুল দুজনই বেসরকারি চাকরিজীবী। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ইনজেকশনের পর এ সময় যেসব পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার কথা, সেসব পরিমাণমতো খেতে পারছেন না বলে জানান তিশা। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জটিলতা থাকায় এক দিন পরপর ইনজেকশন নিতে হচ্ছে। সেটার দাম ৪৫০ টাকা করে। অর্থসংকটে বেশ কয়েকটি ইনজেকশন নিতে পারিনি। ডাক্তার বলেছেন, প্রতিদিন দুইটা ডিম খেতে। কিন্তু আমি একটাও খেতে পারি না। দুধ তো খাওয়াই হয় না। মাংস বা মাছ একটা কিছু তো খেতে হবে। সেটাও পরিমাণমতো খাওয়া হচ্ছে না।’

গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব হলে শিশু অপুষ্ট হয়। খর্বাকায় শিশুর জন্ম হয়। তাই সেই সময় পুষ্টির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে জানান সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুহি জাকারিয়া। তিনি বলেন, ‘বাচ্চার কাছে যে পুষ্টি যায়, তা মায়ের রক্তের মাধ্যমেই যায়। মা খেতে না পারলে বাচ্চাও খাবার পাবে না। শুধু বাচ্চাই না, মায়েরও অসুবিধা হবে। মায়ের রক্তশূন্যতাও হতে পারে।’ 

ইউনিসেফের গত বছরের মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ১২ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের মধ্যে ১২ শতাংশেরই ওজন তাদের বয়স ও উচ্চতার তুলনায় কম। এই বেহাল অবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করছে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি। চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের।

নিম্নবিত্তদের বেহাল অবস্থা 

বাজারের দোকানে দোকানে ঘুরে মুরগির পা, গিলা কলিজা খুঁজছেন খুদেজা বেগম। এক ছেলে, ছেলের বউ ও নাতির সঙ্গে মোহাম্মদপুরে থাকেন তিনি। তিনি বলেন, ‘নাতিটার বয়স ৬ বছর। ভালো-মন্দ কিছুই খাওয়াইতে পারি না। তাই দোকানে দোকানে ঘুরছি। মুরগির মাথা, পা যা পাই রান্না করে দিব। কেউ দিতে চায় না। তা-ও আশা ছাড়ি না। নিজেরা যাই খাই না কেন, বাচ্চার তো ভালো কিছু লাগে। ছেলে রিকশা চালায়। তার আয়ে তো সংসার চলে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি যদি আলাদা বাসায় থাকি, আরও ২ হাজার টাকা বেশি লাগব। তাই টাকা বাঁচাইয়া হেইডা দিয়া পোলা আর নাতিরে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াই। আমি তো মা, ছেলেরে ফালাইয়া নিজেরটা ভাবতে পারি না।’

মহাখালী কড়াইল বস্তিতে থাকেন শাকীনা আক্তার। নিজের ৭ মাস বয়সি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা মেডিকেলের সামনে। মা, বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে সন্তানকে নিয়ে থাকেন তিনি। মা গার্মেন্টসে চাকরি করেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না সংসার টানতে। শাকীনা বললেন, ‘বাচ্চা দুধ খেতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে সাহায্য চাইছি। কিছু টাকা হলে ওর জন্য দুধ কিনব।’

ময়মনসিংহ থেকে ভিক্ষা করতে এসেছেন রাজিয়া। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দেখিয়ে ষাটোর্ধ্ব রাজিয়া বললেন, ‘একটু নুন, একটু হলুদ কিনমু। আর ডিম কিনলে দুইডা কিনা লাগব। দুই নাতিই ডিম পছন্দ করে। একটা ডিম নিয়া ঢুকলে ঝগড়া হইব। একজন একটা পেয়ারা দিছে। ওটা বাড়িত নিয়া নাতি-নাতনিরে কাইট্টা দিমু।’

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব নারীদের ওপর বেশি পড়াটাই স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি, আমাদের সমাজে বেশিরভাগ নারীই অভাবের সময় নিজের খাবারটাও পরিবারের জন্য রেখে দেন। এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক চিত্র। তবে যদি দীর্ঘদিন এটা চলতে থাকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যাবে। 

তিনি বলেন, গর্ভবতী নারী এবং ভূমিষ্ঠ শিশুদের ক্ষেত্রে সরকার কিছু সেবা দেয়। কিন্তু যদি কারো জটিলতা থাকে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যয়েও একটা টানাটানি হয়। এখন আমাদের রাজস্ব যদি হয় ৭ শতাংশ, তারপর ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করা উচিত হবে না। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা