× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রিজার্ভ পতনের নেপথ্যে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি

রেদওয়ানুল হক

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৭ এএম

আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:২৭ পিএম

রিজার্ভ পতনের নেপথ্যে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি

নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা শুরু হয়। এতে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমে এলেও রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি। অতীতে এ হিসাব উদ্বৃত্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ক্রমাগত বাড়ার অর্থ হলো দেশে যে পরিমাণ ডলার ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের ইতিহাসে আর্থিক হিসাবে এত বড় ঘাটতি এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠা এবং রিজার্ভ কমে যাওয়ার পেছনে এ ঘাটতির প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি মিলছে না রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য খাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ। বিদেশি ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। কমেছে বিদেশি দান-অনুদানও। মোটা দাগে এগুলোকে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আর্থিক হিসাবে ঘাটতি আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে দুর্বলতা বাড়িয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি যদি দূর করতে না পারি তাহলে আমাদের সার্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবে।’

আমদানি নিয়ন্ত্রণের পলিসি দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব তৈরি করতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘টেকসই নীতি গ্রহণের বিকল্প নেই। আমাদেরকে সব খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। কারণ অর্থনীতির একটি সূচক অন্যটিকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স বাড়ানোর কার্যকরী পদক্ষেপ, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও ম্যাক্রো অর্থনীতির দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে সব খাতের দুর্বলতা দূর করতে হবে।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৩৯ কোটি ডলারে। অথচ গত বছরের একই সময়ে এই সূচকে ১৪৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১৪ কোটি ডলারের ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়, যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সূচকে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল। করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘আর্থিক হিসাবের ঘাটতি জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ইতিহাসে এমনটা আর কখনো দেখা যায়নি। এর অর্থ হলো দুটি ঘটনা পাল্লা দিয়ে ঘটছে। প্রথমত. দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত. আমাদের ঋণ বাড়ছে। জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নিলে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের ওপর নিম্নমুখী চাপ আরও ঘনীভূত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতি।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এক বছর আগে ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি এ হিসাব দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৭ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে দেশের বিদেশি লেনদেনের ঘাটতি কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি বাণিজ্যের ঘাটতি কমেছে ৬২ শতাংশ। 

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে দেশের পণ্য আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৫৮ কোটি ডলার। একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৪৫৯ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ১ ডলার ১১০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৫০ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ২৩১ কোটি ডলার। 

প্রসঙ্গত, আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি। আমদানি কমায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই ঘাটতি ৩৩৩ কোটি ডলারে নেমে এসে অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি ছিল ৪৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩৪ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২০৫ কোটি ডলার। মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়। জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে এই সূচকে ঘাটতি ছিল ২০৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ সেবা খাতের ঘাটতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অন্যদিকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। সবশেষ তথ্য বলছে, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে চলতি হিসাবে কোনো ঘাটতি তৈরি হয়নি। এই সূচকে উল্টো ইতিবাচক ধারা দেখা গেছে। এই সময়ে ১৯২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল। আগের অর্থবছরের একই সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪৯২ কোটি ডলার ।

অন্যদিকে বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯২৭ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৭ কোটি ডলার। কিন্তু বর্তমানে ঘাটতির বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না দেশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) সামগ্রিক হিসাবে (ওভার অল ব্যালেন্স) ঘাটতি রয়েছে ৩৬৭ কোটি ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৬৪৫ কোটি ডলার। সে হিসাবে ঘাটতি অনেকটা কমেছে।

এদিকে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশ যেখানে ২৫২ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলারে নেমেছে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এ অঙ্ক ছিল ৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ নিট বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় ১৪ কোটি ডলার কমে গেছে। 

এছাড়া আলোচিত সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল, তার চেয়ে ৮ কোটি ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৭৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৪৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স বেড়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা