প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:২৭ এএম
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৫১ পিএম
ফাইল ছবি
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংক থেকে ডলার তুলে নেওয়ার নতুন কৌশল নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারেন্সি সোয়াপ বা মুদ্রা বিনিময় পদ্ধতির মাধ্যমে ডলার জমা নিয়ে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহ করা হবে। এতে টাকার সংকট কাটিয়ে উঠবে বাণিজ্যিক ব্যাংক আর রিজার্ভ সমৃদ্ধ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তাই এ পদ্ধতিকে উভয়পক্ষের লাভ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা। তবে চলমান সংকটের মধ্যে এ পদ্ধতি খুব কাজে আসবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ভাটা হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে। এতে এলসি নিষ্পত্তিতে বিপাকে পড়তে পারে অনেক ব্যাংক।
জানা গেছে, গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া ঋণের শর্ত পূরণে ব্যাংক থেকে ডলার ক্রয় করে রিজার্ভ বাড়ানোর কৌশল নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের বেশি কিনে রিজার্ভ কিছুটা বাড়ানো হয়। এতেও শর্তের সমপরিমাণ রিজার্ভ সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি। তখন সংকটের মধ্যে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু হলে ডলার কেনা বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ডলার বিক্রি না করে তারল্য সহায়তায় বেশি আগ্রহী হয়। এমন প্রেক্ষাপটে সোয়াপ পদ্ধতি সামনে আনা হয়েছে। এতে ডলার বিক্রি না করে বরং বন্ধক রেখে টাকা সংগ্রহ করার সুযোগ তৈরি হলো। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেও এ পদ্ধতির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া মেলে। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর নয়া কৌশল হিসেবে গতকাল কারেন্সি সোয়াপ সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই পদ্ধতির ফলে উভয়পক্ষের একটি অপশন বাড়ল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়াতে ডলার দরকার আর ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে দরকার টাকা। এখন যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার জমা থাকবে, তারা টাকা এনে বিনিয়োগ করবে; আবার যখন প্রয়োজন হবে টাকা জমা দিয়ে ডলার আনতে পারবে। তবে এ পদ্ধতি বর্তমানে খুব বেশি কাজে আসবে না। কারণ বর্তমানে ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত ডলার আছে বলে মনে হয় না। অনেক ব্যাংক ডলার সংকটে এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছে।’
এ ব্যবস্থার কারণে আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন কমে যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে না, তাই আন্তঃব্যাংকের লেনদেন কমবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
তবে ব্যাংকাররা বলছেন, এ ব্যবস্থার ফলে ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রিতে অনাগ্রহী হবে। তারা আন্তঃব্যাংকে বিক্রি না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোয়াপ করবে। কারণ প্রয়োজনে তা উত্তোলন করার সুযোগ রয়েছে। ফলে যেসব ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তির জন্য অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনত, তারা বিপাকে পড়বে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনা সহজ হবে না। বর্তমানে কেবল জরুরি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিতে ডলার সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানতে চাইলে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ পদ্ধতির ফলে আন্তঃব্যাংকে ডলার লেনদেন কমে যেতে পারে। তখন এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু আইএমএফের প্রেশারে রয়েছে; তাই একটা সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকের কাছে এখন অতিরিক্ত ডলার খুব একটা নেই, তবুও ‘যদি থেকে থাকে, তাহলে সেই সুযোগটা নিতে চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
গতকাল বৃহস্পতিবার জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে টাকার সঙ্গে ডলার অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ ব্যবস্থার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডলারের সঙ্গে টাকার অদলবদল করতে পারবে। সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের জন্য টাকা-ডলার অদলবদল করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত ডলার থাকলে এখন তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে তারা সমপরিমাণ টাকা ধার নিতে পারবে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক উভয়পক্ষই লাভবান হবে। কারণ উদ্বৃত্ত ডলারের বিপরীতে ব্যাংকগুলো তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পেয়ে যাবে। আবার নির্ধারিত সময় পর টাকা ফেরত দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ ডলার পেয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে থাকা অতিরিক্ত ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা যায়। তবে প্রয়োজনের সময় ওই ডলার আবার ফেরত পাওয়া যাবেÑ এ নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু সোয়াপ ব্যবস্থায় সেই নিশ্চয়তা রয়েছে। এজন্য বেশিরভাগ ব্যাংক সোয়াপ করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে ব্যাংকে ডলারের জমা বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে। তাই ডলার-টাকা অদলবদলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ ব্যবস্থার আওতায় সর্বনিম্ন ৫০ লাখ ডলার বা তার সমপরিমাণ টাকা অদলবদল করা যাবে। অদলবদলের মেয়াদ হবে সর্বনিম্ন ৭ দিন আর সর্বোচ্চ ৯০ দিন। মুদ্রা অদলবদলের এ সুবিধা নিতে হলে আগ্রহী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চুক্তি হবে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার জমা দেবে, ওইদিনের ডলারের বিনিময়মূল্য হিসাবে সমপরিমাণ টাকা পেয়ে যাবে। একইভাবে নির্ধারিত সময় পর টাকা জমা দিয়ে ডলার ফেরত নিতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে বার্ষিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদ হিসাব করে টাকা ফেরত দিতে হতে পারে। এর মধ্যে ডলারের দামে ওঠানামা হলেও সমপরিমাণ ডলার ফেরত পাবে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ব্যবস্থার ফলে সুবিধা হবে উভয়পক্ষের। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলোর সাধারণ ব্যাংকিং থেকে অফশোর ইউনিটে ডলার স্থানান্তর বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি মূল ব্যাংক থেকে অফশোর ইউনিটে যে অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা-ও চলতি বছরের মধ্যে ফেরত আনতে বলা হয়েছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ে ডলার স্থানান্তর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ব্যবসার জন্য বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ডলার ধার এনেছে, তা ব্যবহার করতে পারছে না। এখন এসব ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা নিতে পারলে সেই অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এর মাধ্যমে এটা বলার কারণ নেই যে, ব্যাংকে অনেক ডলার অলস পড়ে আছে। কারণ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু সংকট আছে, তাই কারও কাছে ডলার থাকলে আন্তঃব্যাংকে বিক্রি হতো। তাই মোটা দাগে এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, আমরা সংকট উতরে গেছি।’