রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪ ০৯:১২ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১১:২১ এএম
দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিয়ে হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা। সেই লক্ষ্য থেকেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে লাফিয়ে বাড়ছে সুদের হার। অন্যদিকে লাভজনক হচ্ছে বন্ডে বিনিয়োগ। আবার কমছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। এই অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহজ-সরল কোনো সমাধানও আপাতত দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। তবে সাত মাসের ঋণ বিতরণের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জানুয়ারি মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রভাব বর্তমানে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমার পেছনে দৃশ্যমান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা টাকার সংকট। এই সংকট মেটাতে প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিছু ব্যাংক ধার করে চলছে। এর মধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সঙ্গে রয়েছে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব। চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা কাজ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৭৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা, আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল যা ৭৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যেভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে তাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, যা দেশের জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের রিকোয়ারমেন্ট ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় যদি ক্রেডিট গ্রোথ মাত্র ১০ শতাংশ হয়, তখন আমাদের জন্য খুব ডিফিকাল্ট সিচুয়েশন হয়ে যায়। আমরা যদি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাড়াতে না পারি তাহলে প্রোডাকশন (উৎপাদন) কমিয়ে দেওয়া ছাড়া টিকে থাকার অন্য রাস্তা নেই। এক্ষেত্রে ঋণ নিতে না পারলে প্রোডাকশন কমিয়ে দিতে হবে। যদি লম্বা সময় ধরে প্রোডাকশন কম হয়, তখন শ্রমিক কমানো ছাড়া উপায় নেই।
ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন তাদের একটি অংশ ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আর দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে অদৃশ্য খেলাপি ঋণও অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে যেসব ব্যাংকের কাছে আগে বড় অঙ্কের অলস টাকা পড়ে থাকত তারা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তারল্য সংকট মেটাতে কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ধার নিচ্ছে। আর আন্তঃব্যাংক কলমানিতে ধার করছে ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর এ কারণে একশ্রেণির ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ একদিকে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ঋণ দিলে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়।
বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করলে একদিকে নিশ্চিত বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে, অপরদিকে খেলাপি হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না। মন্দমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে কমে যায় ব্যাংকের আয়। দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো। সব মিলিয়ে এখন একশ্রেণির ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। যার প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার বড় একটি কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। যার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নীতি সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিনিয়োগের সুদ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলো যখন টাকার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে তখন তাদেরকে বেশি সুদের বিনিময়ে ধার নিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। এই ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বেড়ে গেছে ঋণের সুদহার। আর ঋণের সুদহার বাড়ার কারণে বেড়ে গেছে ব্যবসার ব্যয়।
একই সঙ্গে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে গেছে। সার্বিক এই পরিস্থিতির ওপর বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব তো রয়েছেই। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোগ ব্যয় কমে যাওয়াÑ ইত্যাদি মিলিয়েই বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান কমার ঝুঁকি কতটা বাড়ছে তা জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না এটা নিশ্চিত। তবে কমবে কি না তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যভাবে বলতে গেলে কর্মসংস্থান কমছে। কারণ প্রতি বছর আমাদের শ্রমবাজারে ৩ শতাংশ শ্রমিক ঢুকছে। এদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে, বর্তমান কর্মসংস্থান ঠিক থাকলে সার্বিক কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে বলে গণ্য করতে হবে। নতুন কর্মীদের কাজ দিতে না পারলে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’
এমন অবস্থা দেখা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘আমাদের আর্থিক খাতের অবস্থা এমনিতেই ভালো না। নানা অনিয়মের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মন্দ লোকদের অপরাধের খেসারত ভালো ব্যবসায়ীদের দিতে হয়। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগও এখন নেই। কারণ অর্থনীতি এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে যে, মূল্যস্ফীতি কমাতে অন্য সব বিষয়ে ছাড় দিতে হবে।’
এদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিতেও রাজি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে হলেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চাইছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ (বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর) ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অর্থনীতিতে সব একসঙ্গে করা যায় না। আমরা যদি মূল্যস্ফীতি টার্গেট করি তাহলে প্রবৃদ্ধিতে ছাড় দিতে হবে। এখন যেহেতু আমাদের প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি, তাই প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমে গেলেও আমরা এটি মেনে নেব।’
প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কর্মসংস্থানের ঝুঁকি ছাড়াও নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে; তবে এ মুহূর্তে কিছুই করার নেই নীতিনির্ধারকদের। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই মুহূর্তে ঝুঁকি নিতেই হচ্ছে। আমার যদি শরীরে ইনফেকশন থাকে তাহলে কি ডাক্তার অপারেশন করবে? ডাক্তার তো একটা দাঁতও তুলবে না।’ ঠিক এভাবে অর্থনীতিতেও এখন মূল্যস্ফীতি না কমিয়ে কিছুই করা যাবে না।