প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১১:২৫ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৪ ১১:৩১ এএম
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ইফতারি কেনাকাটাতেও সংযমী হয়েছে মানুষ। শুক্রবার পুরান ঢাকার চকবাজারে
দুপুর প্রায় ২টা। রাজধানীর জিরো পয়েন্টের দিকে মুখ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন একজন সিএনজিচালক। কপালে চিন্তার ভাঁজ। কথা বলে জানা গেল, তার নাম মোশাররফ হোসেন। বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে। পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার মিরপুরে।
গতকাল শুক্রবার কথা প্রসঙ্গে মোশাররফ জানালেন, বর্তমানে সিএনজি চালিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বিশেষ করে রোজা শুরু হওয়ার পর আয় অনেক কমে গেছে। এর কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন সিএনজির মালিককে ভাড়া বাবদ জমা দিতে হয় ১২০০ টাকা, গ্যাস কিনতে হয় ৪০০ টাকা। এর সঙ্গে রাস্তায় পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের চাঁদাসহ তার প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর যে টাকা হাতে থাকে তা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন। অর্থাৎ দিনে আড়াই বা তিন হাজার টাকা ভাড়া পেলে ৫০০ বা ১ হাজার টাকা ঘরে নিতে পারেন। প্রথম চার রোজায় সেহরিতে খাবারের তালিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রথম দিন আধা কেজি গরুর মাংস কিনেছিলেন। তারপর থেকে ব্রয়লার বা অন্য কোনো মাংস আর খাননি। দুধ পান করেছেন এক দিন।
মোশাররফ হোসেন বলেন, বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা তাতে তাদের মতো বেশিরভাগ সিএনজিচালকের খাবারে ভালো কিছু জুটছে না। ইচ্ছা থাকলেও ভালো খাবার খেতে পারেন না। একদিকে তরিতরকারি ও অন্যান্য সদাইপাতির দাম বেশি। আবার তাদের রোজগারও এখন কম। সব মিলে সংসারের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর তেজকুনিপাড়ার গরিবের বাজারে (ফকিন্নির বাজার হিসেবেও পরিচিত) সবজি বিক্রি করেন মো. চান মিয়া। তার দোকানে কিছু বেগুন, টমেটো, করলা, শসা, আলু, শিম, কাঁচা মরিচ ও ধনেপাতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রথম চার রোজায় সেহরিতে কী খেয়েছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এ বাজারে সাধারণত গরিব কাস্টমার আসে। আমাদের বিক্রি যেমন কম, আয়ও কম। আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়। সেহরিতে এক দিন ব্রয়লার মুরগি, দুই দিন মাছ ও আরেক দিন ডিম-সবজি খেয়েছি।
তিনি বলেন, বাজারে সবকিছুরই দাম বেশি। আমরা নিজেরাই বিক্রি করি এজন্য অন্যের কষ্টটা বুঝি। এক কেজি লম্বা বেগুন বিক্রি করতে হয় ৬০ টাকার ওপরে। দিনে হয়তো ২ হাজার বা ২ হাজার টাকার মাল কিনি। এই মাল প্রতিদিন সব বিক্রিও হয় না। কিছু পচে যায়।
বিজয়সরণির কলমিলতা কাঁচাবাজারে মাছ বিক্রি করেন আব্দুল আজিজ। মুন্সীগঞ্জের এ ব্যক্তি তেজকুনিপাড়ায় পরিবারসহ ভাড়া থাকেন। ছেলেমেয়ে-স্ত্রীসহ চারজনের সংসার তার। তিনি জানান, নিজে মাছ বিক্রি করার কারণে প্রতিদিনই মাছ খেতে পারেন। কিন্তু দুধ বা মাংস খাওয়া বেশি একটা হয় না। বাজারে বিক্রিবাট্টা কম। দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করাও দুরূহ। দোকানভাড়া, বাসাভাড়া, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচসহ সব মিলাতে গেলে সংসার চালানো ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। আর রোজায় পণ্যের দামও বেশি থাকে। সব মিলে রোজায় সংসারের খাবারে কিছুটা কাটছাঁট করতে হয়।
এবারের রোজায় দ্রব্যমূল্যের চাপে বেশিরভাগ মানুষকেই ইফতার ও সেহরির খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট করে চলতে হচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষ তো দিশেহারা অবস্থায় আছেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও খুব একটা ভালো নেই। আগের ইফতারি-সেহরিতে ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন আর করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে ফল খেতে গিয়ে
স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তেজকুনিপাড়ায় থাকেন তাহমিনা আক্তার। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কিছুটা বিপাকে আছেন তিনি। জানান, বাচ্চাদের ফল খাওয়াতে পারছেন না। আগে ইফতারিতে মিষ্টি আর ফল রাখতেন। এখন সেটা আর থাকে না। পেট ভরলেও পুষ্টির কথা ভাবলে সেদিক বিবেচনায় সব খাবার রাখা যাচ্ছে না।
একই কথা জানান গৃহিণী সালেহা বেগম। ইফতারিতে সব সময় ছোলা, মুড়ির সঙ্গে পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি না থাকলে হতোই না। তবে এখন ছোলা আর মুড়িই খান। শরবতটা সব সময় থাকে। তবে আগের মতো আর অনেকগুলো আইটেম রাখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, তেলের দাম বেড়ে গেছে। এত সব বানাতে গেলে তো তেলের খরচ হবে। বেগুনের দামটাও তো কম না।
উত্তরার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সৈয়দ সোয়াহিব ইমতিয়াজ। গত বছর পুরো রমজান মাসে ১০ হাজার টাকার মধ্যে ইফতারের বাজার হয়ে গেলেও এ বছর অঙ্কটা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, আজকে (শুক্রবার) পর্যন্ত আমার খরচ হয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। রমজানের বাকি দিনগুলো তো পড়েই আছে। তিনি বলেন, এ বছর সব জিনিসের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ডাল গত বছর ছিল ৯০ টাকা কেজি কিন্তু এবার ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ছিল ১৮০ টাকা এবার সেটা ২৩০ টাকা, সয়াবিন তেলের দামও এবার অনেক বেশি। যদি ইফতারের কথা বলি, তাহলে সেখানে ফলের গুরুত্ব আমি বেশি দিই। কিন্তু এবার ফলের দাম অনেক। নাগালের বাইরে চলে গেছে ফলের দাম। গত বছর তরমুজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে কিনেছি যেটা এবার ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, সব জিনিসেরেই দাম বেশি। বলতে গেলে তালিকা অনেক লম্বা হয়ে যাবে।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা রাজিব খান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমাদের অবস্থা শোচনীয়। ইফতারিতে আগে আমরা ফল রাখতাম। কিন্তু এবার বিদেশি ফল দূরের কথা দেশীয় ফলও রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সবজির দাম কোনোটাই ৫০ টাকার নিচে নেই। রোজাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে গেলে দেখা যাবে পাঙাশ মাছ ছাড়া আর সব মাছই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর উৎপাদন খরচ এত বেশি নয়, যত বেশি দাম রাখা হয়। আসলে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে উচ্চমূল্যে সব জিনিস কিনতে হচ্ছে। চালের দামও গত বছরের চেয়ে এবার অনেক বেড়েছে। আমি মনে করি সঠিক মনিটরিং থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সরকারের কাছে অনুরোধ বাজার নিয়ন্ত্রণে যাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
রাজধানীর আজিমপুর এলাকায় মেসে থাকেন রোহান ইসলাম পিয়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ফল তো আমাদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। দেশীয় পেঁপে, পেয়ারাও আমরা ইফতারে রাখতে পারি না। আর খাবারে পাঙাশ কিংবা তেলাপিয়া আমাদের ভরসা। এবার উচ্চমূল্যের প্রভাব সবকিছুতে পড়েছে। খাবারের পুষ্টিমান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খুব খারাপ
৫৫ বছর বয়সি সালেহা খাতুন ছেলে আর ছেলের বউয়ের সঙ্গে পশ্চিম রাজাবাজারে থাকেন। পেশায় গৃহকর্মী সালেহা বলেন, ইফতারের সময় মুড়ি আর শরবত খাই। কোথাও পেলে একটু ছোলা খাই। হাতে টাকা থাকলে সেহরিতে সাধারণত সবজি আর মাছ খাই। এর বেশি আর কিছু খাইতে পারি না।
শ্রমজীবী যেসব মানুষ রাস্তাঘাটে ইফতার করেন তারাও কাটছাঁট করেছেন নিজেদের খাদ্যতালিকায়। হাতিরপুল বাজারে কয়েকটি রিকশা একসঙ্গে জড়ো হয়ে যাত্রী খুঁজছিল। সেখানে কথা হয় রিকশাচালক শামসের আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যা পাই তা খাই। আগের মতো সব খেতে পারব না সেটাই তো স্বাভাবিক।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নূরুল হক। এখানেই একটি বাসার দারোয়ান তিনি। নূরুল হক বলেন, চার মেয়ে নিয়ে সংসার চলে না। সত্যি বলতে কোনো আয়োজন ইফতারিতে থাকে না। দুইটা চিড়া খেয়ে কাটাইতেছি।
২০ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান মো. রেজাউল করিম। কথায় কথায় তিনি বলেন, আগে দুই টাকা, পাঁচ টাকা দিয়ে বরা (পেঁয়াজু) খাইছি, চপ খাইছি। এখন সেটার দাম দশ টাকা। বুরিন্দা খেলে ২০ টাকা দিতে হয়। এত খরচ করে আমরা ইফতার কেমনে করব?