× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাগরে বেড়েছে জেলিফিশ উধাও ইলিশ রূপচাঁদা কোরাল

এস এম রানা, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:২০ এএম

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৪ ১০:৫৪ এএম

বঙ্গোপসাগর । ফাইল ফটো

বঙ্গোপসাগর । ফাইল ফটো

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে ১২৮ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার এলাকা হিসেবে ‘ফিশিং গ্রাউন্ড’ নামক স্থানে যান জেলেরা। সেখানকার ৪০ থেকে ৬০ মিটারের বেশি গভীরতায় মাছ আহরণের প্রতিযোগিতা চলে কাঠ ও ইস্পাতের তৈরি ৫০ থেকে ৪০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজের। এবার ভর মৌসুমে সেখানে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা চোখে পড়ে না। জেলেদের জালে মাছের পরিবর্তে উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে জেলিফিশ। খাওয়ার অযোগ্য এই জেলিফিশের কারণে সাগর থেকে উধাও হয়ে গেছে ইলিশ, রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্কাসহ প্রায় সব প্রজাতির মাছ।

দেশে বর্তমানে মাছের চাহিদা বছরে প্রায় ৪৫ লাখ টন। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৭ লাখ টন। চলতি মৌসুমে সামুদ্রিক মাছ আহরণে বড় ধরনের ধাক্কা লাগায় চট্টগ্রামের বাজারে সামুদ্রিক মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। বাজারে মাছের সংকটের বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের মেরিন ফিশারিজের পরিদর্শক এস এম সাজ্জাদ হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, চট্টগ্রামে ফিশিং জাহাজ আছে ২২১টি। এগুলো গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে। এর বাইরে কাঠের ছোট ট্রলার আছে ২৯ হাজারের মতো। চলতি মৌসুমে সাগরে জেলিফিশের আধিক্যের কারণে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। গত জানুয়ারি মাস থেকে এই সংকট শুরু হয়েছে। সমুদ্রে কেন জেলিফিশ বেড়েছে এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন।

ইলিশসহ অন্য মাছের বদলে জেলিফিশ ধরা পড়ায় আবারও সাগরে জাল ফেলতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলেদের। মাছের পরিবর্তে জালে জেলিফিশ ওঠা বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা সাগর ছেড়ে এখন তীরে ফিরেছেন। প্রায় তিন মাস ধরেই চলছে এই সংকট। কবে নাগাদ এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে সেটাও বলতে পারছেন না কেউ। এদিকে সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় বাজারে পড়েছে এর প্রভাব। সাধারণ ভোক্তারা পড়েছেন মাছের সংকটে। এরই মধ্যে আগামী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। ফলে চলতি মৌসুমে জেলেরা আবার সাগরে গিয়ে মাছ ধরতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া এই সংকট মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলছে। ফলে এখন চট্টগ্রামের অধিকাংশ ফিশিং ট্রলার সাগরে না গিয়ে কর্ণফুলী নদীতে অলস বসে আছে। সাগরে মাছ না পাওয়ার কারণে শুধু জেলেরা দুর্ভোগে আছেন তা নয়, সঙ্গে ফিশিং ট্রলার মালিকরাও পড়েছেন চরম ক্ষতির মুখে। একটি জাহাজ জেলেদের নিয়ে নদীতে অলস বসে থাকলেও মাসে কমপক্ষে ২০-২৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয় মালিকদের। এ কারণে বাধ্য হয়ে কোম্পানি গুটিয়ে ফেলার চিন্তা করছেন একাধিক ফিশিং ট্রলার কোম্পানিও।

গুটিয়ে ফেলার দুশ্চিন্তায় পড়া কোম্পানির একটি ব্লু সাউথ ফিশিং। কোম্পানিটির পরিচালক সাজিদ বিন সোলায়মান বলেন, ‘জানুয়ারি মাস থেকে সাগরের অবস্থা খারাপ। এখন সাগরে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না, পাওয়া যাচ্ছে জেলিফিশ। তাই মাছ ধরা বন্ধ করে জেলেরা কর্ণফুলীতে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মধ্যে জেলেদের সাগরে মাছ ধরতে পাঠিয়ে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির দুটি ফিশিং জাহাজ আছে। যেগুলো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। দুই জাহাজে নাবিক-জেলেসহ প্রায় ৮০ জন কর্মী রয়েছেন। অফিসে আছেন আরও ১০ জন। এই ৯০ জনের বেতন-ভাতা চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ কারণে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধের চিন্তা করতে হচ্ছে।’

সাগরে মাছের পরিবর্তে জেলিফিশ পাওয়ার বিষয়ে এফভি নাজমঈন-এর ক্যাপ্টেন কবির হোসাইন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘জানুয়ারি মাস থেকেই সাগরের অবস্থা খুবই খারাপ। ২৩ বছর ধরে সাগরে আছি। এমন দুর্ভোগের দৃশ্য আর দেখিনি। ৪০ মিটারের বেশি গভীরতায় আমরা মাছ ধরে থাকি। জানুয়ারি মাসে সেখানে গিয়ে জাল ফেলার পর দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে জেলিফিশ উঠছে। এগুলো খাওয়া যায় না। তাই জাল থেকে সেগুলো পুনরায় সাগরে ফেলে দিতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘জেলে, জ্বালানি ও রসদ নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়াকে আমরা বলি ভয়েজ। প্রতিটি ভয়েজে ২০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজ অন্তত ১০০ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করতে পারে। এখন জেলিফিশ বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০ টন মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ট্রলার মালিকদের বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান হচ্ছে। বাধ্য হয়েই আমরা দুই মাস ধরে তীরে অবস্থান করছি। এই অবস্থা কবে নাগাদ শেষ হবে বলতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফিশিং ট্রলার নদীতে অলস বসে থাকলেও মালিকদের মাসিক অন্তত ২০ লাখ টাকা ক্ষতি হয় বেতন, জ্বালানি এবং বয়া ভাড়া বাবদ। এভাবে মালিকরা কত দিন লোকসান গুনবেন। একসময় হয়তো চাকরি হারাতে হবে আমাদের।’

ট্রলার মালিক এস এম আল মামুন মিয়া বলেন, ‘আমি দীর্ঘ সময় ধরে মাছ ধরার ব্যবসায় যুক্ত। চলতি মৌসুমের মতো বিপর্যকর সংকটে আর পড়িনি। লোকসান গুনতে গুনতে চোখে শর্ষে ফুল দেখছি।’

জেলেরা জানান, গভীর সমুদ্রের সব জায়গায় পানিতে ভাসছে শুধুই জেলিফিশ। ফিশিং জাহাজগুলোতে এক ঘণ্টার মধ্যেই উঠে আসছে ১০-২০ টন জেলিফিশ। এর মধ্যে মাছ ১০০ কেজিও থাকছে না। পানির রঙে স্পঞ্জের মতো দেখতে জেলিফিশগুলো জাল থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে জেলেদের।

সাগরে হঠাৎ জেলিফিশের উপদ্রবের তিনটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে সাগরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং সমুদ্রে কচ্ছপ কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামুদ্রিক কচ্ছপ জেলিফিশ খেয়ে থাকে। সাগরে কচ্ছপ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে ফলে, জেলিফিশের আধিক্য বাড়তে পারে। তবে এ বিষয়ে মন্তব্য করার আগে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, লবণাক্ত বৃদ্ধি, পানির তাপমাত্রার তারতম্যসহ নানা কারণে জেলিফিশের আধিক্য বাড়তে পারে। কচ্ছপের উপস্থিতি কমে যাওয়াও কারণ হতে পারে। তবে এই বিষয়ে মন্তব্য করার আগে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে জেলিফিশের আধিক্য বেশি হওয়ার কারণ জানতে এখনও গবেষণা হয়নি। এটা এখন বেশি জরুরি।’

জাহাজগুলোর তুলনায় কাঠের ট্রলারগুলো সাগরতীরের কাছাকাছি থেকে মাছ ধরে থাকে। গভীর সমুদ্রে যখন জেলিফিশের আধিক্য তখন উপকূলের কাছাকাছি এলাকার বিষয়ে জানতে কথা হয় জেলে মোহাম্মদ সোহেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে ট্রলারের মালিক সাড়ে তিন লাখ টাকার রসদ কিনে আমাদের সাগরে পাঠিয়েছিলেন। সাগরে গিয়ে তিন দিন ছিলাম। দেখি কোথাও জাল ফেলার জায়গা নেই। চারদিকে শুধুই জেলিফিশ। কয়েক স্থানে জাল ফেলেছিলাম। কিন্তু সেই জাল টেনে ট্রলারে তুলতে পারছিলাম না। পুরো জাল ভরে যায় জেলিফিশে। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ফিরে আসি। ফিরে আসার পর মাত্র তিন হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় করে মালিক মাত্র তিন হাজার টাকা পেয়েছেন।’

সাগর থেকে মাছ আহরিত না হওয়ায় বাজারে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজির দেউড়ি কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো. এমরান। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে পাইকারি বাজারে সামুদ্রিক মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় মাছের দামও বেড়েছে। ভোক্তাদের চাহিদা থাকলেও সেই অনুযায়ী মাছ সরবরাহ করতে পারছি না।’

একই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ আফতাব উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মাছের প্রজননের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। আবার লবণাক্ততা বাড়ছে, তারতম্য হচ্ছে তাপমাত্রার। উন্নয়নযজ্ঞের কারণে ইকোসিস্টেমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব কারণে বলা যায়, সাগরে মাছ কমছে। সঙ্গে অনাকাক্ষিত প্রাণীর সংখ্যাও বাড়ছে। এসব জানার জন্য সমন্বিত গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। গবেষণার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা