× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সামর্থ্যে টান

রেদওয়ানুল হক

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪ ১২:১৭ পিএম

আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৩:৫৩ পিএম

তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সামর্থ্যে টান

দীর্ঘ সময় ধরে দেশের ডলার বাজারে অস্থিরতা চলছে। প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। বকেয়া দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং রাষ্ট্রীয় জরুরি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ক্রমাগত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তিন মাসের চেয়ে বেশি আমদানি ব্যয় পরিশোধের সামর্থ্যেও টান পড়েছে। তিন মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ আছে প্রায় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার।

সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নিয়েও কিনারা পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ডলার বিক্রি বন্ধের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রি বন্ধ হয়নি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই রিজার্ভ থেকে ১০ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ২৭ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আইএমএফের হিসাবে এ অঙ্ক ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) অনুযায়ী, রিজার্ভ গণনায় বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ বিভিন্ন তহবিলের পাশাপাশি বিমানকে দেওয়া ঋণ গ্যারান্টি, পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া ঋণ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে আমানত এবং নির্দিষ্ট গ্রেডের নিচে থাকা সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ রিজার্ভের অন্তর্ভুক্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলোকে রিজার্ভ হিসেবে দেখিয়ে আসছে। এসব বাবদ ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে দেখায় আইএমএফ। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কিছু হিসাব অন্তর্ভুক্ত করে না, যেগুলো শিগগির পরিশোধ করতে হবে। সেসব বাদ দিলে বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ প্রায় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর তিন মাসের জন্য দরকার সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সম্প্রতি প্রতি মাসে প্রায় সোয়া ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে।

ব্যয়যোগ্য নিট রিজার্ভের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যয়যোগ্য নিট রিজার্ভ ছিল ১৫.৮ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারিতে ছিল ১৬.৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণে ভাটা পড়ায় এমন হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ঘাটতি সাত বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই সূচকের পতনকে রিজার্ভ কমে যাওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেমিট্যান্সে গতি ফিরলেও তা আশানুরূপ নয়। তা ছাড়া বিদেশি ঋণ ছাড় কমে যাওয়া, সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়া এবং কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না আসাসহ বিভিন্ন কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তা সময়মতো দেশে আসছে না। রপ্তানি আয় সময়মতো দেশে না আসাকেও আর্থিক হিসাবের ঘাটতির বড় একটি কারণ মনে করা হচ্ছে।

রিজার্ভ তৈরি হয় কীভাবে

রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় বা আয় হয় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে ওঠে। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদেশে পর্যটন বা পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভ তহবিলে যোগ হয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

রিজার্ভের মজুদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। ৫ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছে। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর করোনা মহামারির মধ্যেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওই দিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০৪ কোটি) ডলারে উঠে যায়। এরপর থেকে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ সালে ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার এবং সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি

বাজারে ডলার সংকট কাটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। একই সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা ছাড়া আরও ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সোয়াপ পদ্ধতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বন্ধক রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নীতিগত ভুলের কারণে ডলার বাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে বিকল্প ছিল না। জরুরি এলসি নিষ্পত্তির জন্য বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে এখনও। তাই ডলারের সরবরাহ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা না গেলেও ধাপে ধাপে সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে সংকট আরও গভীর হবে।

দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হলে পাচার বন্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডির লাগাম টানতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠাতে হবে। তা ছাড়া রপ্তানি আয় বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ কেবল পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিতে নতুন নতুন পণ্য যোগ করতে হবে। আর ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের বিকল্প হিসেবে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। তা ছাড়া রপ্তানি আয়ের সব অর্থ দেশে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, তারা কাজ করে যাচ্ছেন। রেমিট্যান্স বাড়াতে নীতিমালা সহজ করা হয়েছে। প্রবাসীদের মধ্যে ইতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। হুন্ডি বন্ধে কাজ করছে বিশেষ দল। পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াতে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি ও এডিবি ঋণের টাকা রিজার্ভে সমন্বয় করা হয়েছে। আরও কিছু ঋণ পাইপলাইনে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ডলার বাজারের পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। এখন খোলা বাজারে ডলারের মজুদ বেড়েছে। দামও কমেছে। অনেক ব্যাংকের কাছে এখন ডলারের মজুদ বাড়ছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সোয়াপ করছে। অর্থাৎ ডলার পরিস্থিতির দিন দিন উন্নতি হচ্ছে বলে তার দাবি। তার কথা ঠিক হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকার কথা। সে চিত্র শিগগিরই দেখা যাবে বলে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা