সাকরাইন
জয়ন্ত সাহা
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:১৪ পিএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩৯ পিএম
ঘুড়ি উড়িয়ে, হই-হুল্লোড়ে দিন কেটেছে পুরান ঢাকার ছেলে-বুড়োদের। প্রবা ফটো
শনিবার সকালে ঢাকার আকাশটা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। পৌষের শেষ দিন হওয়ায় শীতও অনুভূত হচ্ছিল বেশ। তবে কুয়াশা আর শীত দমাতে পারেনি ছেলে-বুড়ো কাউকেই। বাড়ির ছাদে তাদের সকাল থেকে বিকাল কেটেছে ঘুড়ি উড়িয়ে, হই-হুল্লোড়ে।
প্রতিবছর পৌষের শেষ দিন পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসব বা ঘুড়ি উৎসব হয়। তার ধারাবাহিকতায় পুরান ঢাকার কলতাবাজারের কুঞ্জবাবু লেনে রতন বসাকের বাড়িতে চলছিল ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম। খুদে কিশোর, মোহন, রত্না, তৃষ্ণাদের কারও হাতে পঙ্খীরাজ, কারও হাতে বোমা, কেউ বা কাউঠাবাজ, রকঘুড্ডি, গগন্দার ঘুড়ি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত দিন পার করেছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনমান তারা ব্যস্ত ছিল সুতা, নাটাই আর মাঞ্জা নিয়ে।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল নামতে শুরু করে, তখন তারা যায় বাড়ির ছাদে। দলে যোগ দিতে ভুল করেননি বৃদ্ধরাও। পৌষের আকাশে ঘুড়ি কাটাকুটির খেলায় তারাই-বা বাদ পড়বেন কেন!
একটু দূরে লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনে সাকিব, রাকিবের নেতৃত্বে খুদেদের আরেকটি দল মতিমহল, সিংহদার, মাজদার ঘুড়ি নিয়ে ওঠে বাড়ির ছাদে৷ কাউঠাবাজ, রকঘুড্ডি, গগন্দার ঘুড়িগুলো তারা কাটবেই; শক্ত পণ করে বসেছে সবাই। ঘুড়ি নিয়ে তুমুল ‘তর্কাতর্কির’ মধ্যে দূর আকাশে রাকিবের মতিমহলে কাটা যায় একটি কাউঠাবাজ। অমনি ‘ভো-কাট্টা’ হল্লাহাটিতে মেতে ওঠে পুরো ছাদ৷
তবে ঘুড়ি উড়িয়েই যে কিশোর, মোহন, রত্না, তৃষ্ণাদের দিন কেটেছে তা নয়; আকাশে ছিল আতশবাজির ঝলকানিও।
সাকরাইন উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানোই মূল আকর্ষণ। ঘুড়ির নামগুলোও বাহারি। লাভ, নিউ ইয়ারের পাশাপাশি ছোটদের জন্য ছিল গ্যাস বেলুন, তারাবাতি, মাছলেঞ্জা ইত্যাদি। খুদেদের দলে পছন্দের শীর্ষে ছিল ছোট ভিম, মোটুপাতলু, বেনটেইন ঘুড়িগুলো! বড়দের হাতে ছিল চারগোয়া, দুই গোয়া, লাভ, ডাব্বা, গরুর মাথা, নাকবাহার, মুখবাহার, গগন্দার, মতিমহল, সিংহদার, মাজদারসহ আরও হরেক রকমের ঘুড়ি।
কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে বাহারি আর রঙচঙে ঘুড়ির ওড়াওড়ি চলে বিকালজুড়ে। আর সন্ধ্যা নামতেই পুরান ঢাকার আকাশ ছেয়ে যায় বাহারি সব আতশবাজিতে। এরই মধ্যে তরুণদের কেউ মুখে আগুন নিয়ে নানা কসরত দেখায়। সাউন্ড বক্সে বাজে ডিজে গান।
শনিবার সাকরাইন উৎসব উদযাপন করলেও পৌষ সংক্রান্তির ধর্মীয় পর্বটি অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল রবিবার (১৫ জানুয়ারি)।
তাঁতিবাজারের শ্রীশ্রী জগন্নাথ জিও মন্দিরের সেবায়েত দেবদাস গোস্বামী জানান, দেবতাদের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় বলে পরবর্তী উদয়ের ব্রহ্মমুহূর্ত থেকে (গোস্বামী মতে) দেবতাদের দিবা (দিন) শুরু হয়। ওই সময় স্বর্গবাসী ও দেবলোকের সবার নিদ্রা ভঙ্গ হয় এবং নিত্য ভগবৎ সেবামূলক নানা ক্রিয়া শুরু হতে থাকে বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে। রবিবার সকাল থেকেই শুরু হবে এই আচার-অনুষ্ঠানের পর্ব।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার গোয়ালানগর লেনের দুর্গা মন্দিরে ছিল সংক্রান্তি পূজা, স্থানীয়রা যাকে বলছেন ‘বুড়ো বুড়ির পূজা’। এই পূজা মূলত শিব-দুর্গার পূজা, যাকে হরগৌরীর পূজাও বলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বিশ্বাস করেন এই দিনে শিব-পার্বতী কৈলাস ছেড়ে ধরাধামে নেমে আসেন।
পুরান ঢাকায় রাধিকা মোহন বসাক লেন, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ওয়ারীর গৌড়ীয় মঠ, সূত্রাপুরে নর্থব্রুক হল রোড, ঠাঁটারিবাজার, লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ‘বুড়ো বুড়ি’ পূজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি।
আদি ঢাকা সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মানস বোস বাবুরাম জানান, এবার সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে তাদের কোনো আয়োজন নেই৷