সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৬:২৬ পিএম
আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৭:০০ পিএম
সিদ্দিকবাজার এলাকায় বিস্ফোরণের পর উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। প্রবা ফটো
রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের পেছনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও তিতাসের দায় আছে কি না, সেটি তদন্ত করা হবে। বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেছেন, ‘রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার এলাকায় বিস্ফোরিত কুইন সেনেটারি মার্কেট ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এটা রাজউকের দেখা উচিত ছিল, অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ তিতাসের যেসব ব্যক্তিদের এসব দেখার কথা ছিল তারা এগুলো দেখেছেন কি না, সেটিও তদন্ত করা হবে।’
ডিআইজি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সিদ্দিকবাজারের যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটে তার নাম কুইন সেনেটারি মার্কেট। একসময় এটার নাম ছিল কুইন ক্যাফে। ১০ তলা ভবনের প্ল্যান করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেসমেন্ট ও একতলা কমপ্লিট ছিল। এর বেজমেন্টে ছিল রান্নাঘর আর একতলায় ছিল খাবারের হোটেল। এ রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালে ভবনটির সাততলা পর্যন্ত কমপ্লিট করা হয়। বর্তমানে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেজমেন্টসহ সাততলা পর্যন্ত ভবনটি কমপ্লিট আছে। ভবনটির প্রকৃত মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুতে তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী বর্তমানে ভবনটির মালিক।’
বিস্ফোরণের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে যা জানালেন ডিবিপ্রধান
১. বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকত। কোনো গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো হতো না।
২. সাততলা ভবনের বেজমেন্টসহ তিনটি ফ্লোরের কমার্শিয়াল লোকজন, বাসাবাড়ির লোকজনের পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয়, দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় সেখানেও বায়োগ্যাসের জন্ম হতে পারে। এটি বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে।
৩. একসময় এই বেজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের ডোমেস্টিক লাইন এখনও চলমান। ফলে এ লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণ হতে পারে।
৪. ভবন মালিকদের তথ্যমতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তরপাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মাঝখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়োবর্জ্য পদার্থের সেপটিক ট্যাংকি, এসির আউটার ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়োবর্জ্য পদার্থের বায়োগ্যাসের বিস্ফোরণে এমনটি হতে পারে।
৫. ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেজমেন্টে বড় একটি স্যানিটারি দোকান, নিচতলায় পাঁচটি দোকান, দোতলাতে কাপড়ের দুটি দোকান ছিল। এগুলোর জন্য অনেক কাঁচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলোকে সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণ হতে পারে, যেটা এর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।
৬. ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস বা ভবন নয়। এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সিসি ক্যামেরার সার্ভেলেন্সে ছিল এটি। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব।
৭. বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ঢাকা মহানগরীর সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল টিম আলাদাভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন। তাতেই প্রকৃত কারণটি জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত বিস্ফোরকের কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।
৮. ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক, দোকানের মালিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ভবন মালিক ও যারা ভাড়া নিয়ে সেখানে ব্যবসা ও বসবাস করে আসছিল তারা ঘটনার দায় এড়াতে পারে না দাবি করেন হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, ‘সেপটিক ট্যাংক অপরিষ্কার রাখা, এসি মেরামত না করা, গ্যাসের লাইন বন্ধ না রাখার দায় এড়ানো যায় না। সেখানে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না, পার্কিং স্থানও ভাড়া দেওয়া ছিল। সব মিলিয়ে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এজন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি।’
তিনি বলেন, ‘বাড়ির মালিক টাকার লোভে আন্ডারগ্রাউন্ডকে একসময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ারটাইট এসি করা নির্মাণসামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন। দোকানের মালিক বিল্ডিং কোডের বিধান না মেনে ভাড়া নিয়ে বেজমেন্টের এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ভবন মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলার ফল। জান এবং মালের এ ব্যাপক ক্ষতির অভিযোগে ভবন মালিকসহ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
ডিবিপ্রধান বলেন, ‘তবে রাজউকের উচিত ছিল ভবনটি নির্মাণে অনুমতি নেওয়ার পর বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না তা দেখা। যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদেরও উচিত ছিল, যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি, ট্যাক্স নিচ্ছি, তারা বিল্ডিং কোড ফলো করছে কি না। ডিবি পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা ঘটনার তদন্ত করছে। ভবন মালিক, দোকান মালিক, বাসিন্দাদের তো দায় ছিলই, রাজউক ও সিটি করপোরেশনেরও উচিত কার কী দায় ছিল তা তদন্ত করা।’