রাজধানীর গণপরিবহন
সাজ্জাদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩ ০১:০৪ এএম
আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৩ ১১:২৭ এএম
রাজধানীর গণপরিবহন। সংগৃহীত ফটো
রাজধানীতে বাসে ওয়েবিলপদ্ধতির নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত
অর্থ আদায় এখনও চলছে। নিষিদ্ধ এ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে গিয়ে প্রায় যাত্রীদের
সঙ্গে চেকার ও হেলপারদের বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। কখনও কখনও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে।
দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা টাঙানোর কথা থাকলেও বেশিরভাগ বাসে তা-ও থাকে না। দেওয়া
হয় না টিকিট। এসব অনিয়ম বন্ধে প্রশাসনেরও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাসগুলোকে একটি কোম্পানির আওতায় আনতে
হবে।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানিয়েছেন, যেসব বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা
হয় সেসব বাসে থাকে না ভাড়ার তালিকা। আইনানুযায়ী টিকিট দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়
না। পজ মেশিনের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ে পরিবহন মালিক সমিতির নির্দেশনা থাকলেও মালিক ও শ্রমিকরা
তা উপেক্ষা করে চলছেন।
পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ওয়েবিল হলো একটি রুটে নির্দিষ্ট
দূরত্ব পরপর লাইনম্যানের মাধ্যমে যাত্রী হিসাব করার ব্যবস্থা। লাইনম্যানরা নির্দিষ্ট
স্থানে বাস থামিয়ে কতজন যাত্রী আছে তা লিখে দেন। এর ফলে একজন যাত্রীকে বাসে উঠে পরের
স্ট্যান্ডে নেমে গেলেও পরবর্তী ওয়েবিল লেখার স্থান পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। ভাড়া না দিলে
এসব লাইনম্যান ও কন্ডাক্টর যাত্রীদের হয়রানি করেন।
যেমন রাইদা পরিবহন রামপুরা থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত ভাড়া রাখে ১০
টাকা। নতুন বাজারে তাদের একটি চেক আছে। কেউ যদি চেক পার হয়ে অল্প দূরত্ব পরেও নামেন
তাকে ২৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন পরিবহনে যাত্রী হয়ে ঘুরে দেখা যায়, ডেমরা
স্টাফ কোয়ার্টার থেকে মোহম্মদপুর রুটের রমজান বাস, সায়েদাবাদ-টঙ্গী রুটের তুরাগ, পোস্তগোলা
ব্রিজ থেকে-উত্তরা রুটের রাইদা পরিবহন, মিরপুর-১ থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটের
আলিফ পরিবহন, গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটের অছিম, দয়াগঞ্জ থেকে মোহাম্মদপুর
রুটে চলাচলকারী মালঞ্চ, মোহাম্মদপুর-বনশ্রী রুটের তরঙ্গ পরিবহন এবং বনশ্রী-গাবতলী রুটের
রবরব পরিবহনে ওয়েবিলপ্রথা এখনও চালু রয়েছে। অথচ এ পদ্ধতি মালিক পরিবহন সমিতি ও বিআরটিএ
আগেই নিষিদ্ধ করেছে।
মিরপুর-১ থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী আলিফ বাসে দেখা
যায়, মহাখালী আমতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড্ডা লিংক রোড পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার
দূরত্বের ১০ টাকা ভাড়া হলেও আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা। দয়াগঞ্জ থেকে মোহাম্মদপুর রুটে
চলাচলকারী মালঞ্চ পরিবহনের সংশ্লিষ্টরা জানান, এ রুটের ৪টি স্থানে চেক বা ওয়েবিল রয়েছে।
ওয়েবিলপদ্ধতি থাকার সত্যতা স্বীকার করে ঢাকা মেট্রো-ব- ১৫-০০২৫ নম্বর
বাসের সুপারভাইজার মোহম্মদ আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কোম্পানি ওয়েবিল বসাইছে।
তারা আমাগোর থেকে প্রতি ওয়েবিলে ১০ টাকা লয়। আর যাত্রীগো যে হিসেব তারা লেইখ্যা দেয়,
সেই মতো আমাগো টেকা বুঝাইয়া দিতে হয়।’
বেসরকারি চাকরিজীবী শহীদুল ইসলাম জানান, চাকরির কারণে পোস্তগোলা-কুড়িল
বিশ্বরোড রুটে নিয়মিত রাইদা পরিবহনের বাসে যাতায়াত করেন। এই পরিবহনের বাসে ওয়েবিলপদ্ধতিতে
ভাড়া নেওয়া হয়। কিন্তু বাসের কোথাও ভাড়ার তালিকা রাখে না। আইন থাকলেও যেন দেখার কেউ
নেই।
তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু রাস্তা যাব ততোটুকু ভাড়া দেব। কিন্তু তারা
এক চেক থেকে আরেক চেক পর্যন্ত ভাড়া রাখে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বলে প্রায়ই তাদের সঙ্গে
ঝগড়া হয়। ভাড়ার তালিকার কথা বললে তারা (সুপারভাইজার) বলে, ওই সব আমরা বুঝি না। মালিক
যেমন করে হিসাব নেবে আমরা তেমন করে ভাড়া নেব।’
মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত চার কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া ১০ টাকা।
রাশেদ হোসেন নামের একজন যাত্রী অভিযোগ করেন, রবরব পরিবহনের বাসে এ দূরত্বের জন্য ২৫
টাকা আদায় করে। তারা ভাড়ার চার্ট মানে না। ইচ্ছামতো চলে। এসব বাসের যাত্রীরা বেশি ভাড়া
দিতে অস্বীকৃতি জানালে পরিবহন থেকে নামিয়ে দেওয়া কিংবা লাইনম্যানদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার
ঘটনাও ঘটে।
কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইনে এ ধরনের পদ্ধতিতে ভাড়া আদায়ের কোনো
নিয়ম নেই। আইনানুয়ায়ী সরকারনির্ধারিত ভাড়ায় চলতে হবে সব পরিবহনকে এবং ভাড়ার তালিকা
দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। ২০২২ সালের আগস্টে এ আইনের ৩৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী
সরকার ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী
বাসে কিলোমিটার ভাড়া ২ দশমিক ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ভাড়ার তালিকা করে প্রজ্ঞাপন জারি
করা হয়। যা ১ সেপ্টেম্বর কার্যকর হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা।
এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ওয়েবিলপদ্ধতিকে
অবৈধ ঘোষণা করে এবং পজ মেশিনের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ের ঘোষণা করে।
তুরাগ বাসের নিয়মিত যাত্রী সাইদুল ইসলাম জানান, এ পরিবহনের কয়েকটি
বাস ওয়েবিলপদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করে। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত সায়েদাবাদ থেকে রামপুরা
এলাকায় যাই। এ পথের ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার রাস্তার জন্য তারা ভাড়া আদায় করছে ২০ টাকা।
যেখানে সরকারনির্ধারিত ভাড়া ১৮ টাকা। আবার রামপুরা সেতু পার হলেই যাত্রীদের কাছ থেকে
আদায় করা হয় ৩০ টাকা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসিফুর রহমান জানান, কাকরাইল মোড় থেকে
শাহবাগ মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রার জন্য রমজান ও তরঙ্গ পরিবহনের
বাসে ১৫ টাকা আদায় করা হয়।
তিনি বলেন, ‘বাসের কন্ডাক্টররা বলে ওয়েবিল অনুযায়ী বাসের ভাড়া দিতে
হবে। ভাড়া আদায় নিয়ে প্রায়ই যাত্রী ও শ্রমিকদের ঝগড়াঝাঁটি হয়, এমনকি মারামারিতেও গড়ায়।’
রাইদা ব-১২-১৭৭৩ নম্বর বাসের চালকের সহকারী আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমাদের
প্রতি চেকে ১০ টাকা করে দিতে হয়। আর ওয়েবিলে যতজন যাত্রীর হিসাব লিখে দেওয়া হয় ততজনের
হিসাব অনুযায়ী রাতে টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।’
ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
‘তা তো প্রায়ই হয়। কী করব বলেন আমাকে তো ওয়েবিল অনুযায়ী টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।
অনেকেই ওই বিল অনুযায়ী ভাড়া দিতে চান না।’
প্রগতি সরণির কোকাকোলা পয়েন্টের রাইদা কোম্পানির লাইনম্যান মো. রাকিব
বলেন, ‘আমাদের সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুই শিফটে ডিউটি চলে। প্রত্যেক গাড়ি
১০ টাকা করে দিয়ে যায়। এটাই আমাদের বেতন। বলতে পারেন কোম্পানির হয়ে আমরা হিসাবরক্ষকের
কাজ করি। যাতে করে মালিক সঠিক হিসাব ও টাকা বুঝে পান। ভাড়ার সঙ্গে আমাদের চেকের কোনো
সম্পর্ক নেই।’ ওয়েবিল কেন চলছে এর জবাবে তিনি বলেন, ‘যাত্রীরা টিকিট নিতে চান না, সেজন্য
ওয়েবিল চালু রেখেছে কোম্পানি। আবার অনেক সময় যাত্রীরা টিকিট অনুযায়ী ভাড়া দেয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান
নুর মোহাম্মদ মজুমদার জানান, তারা সব অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে।
তবে জনবল সংকটের কারণে এটি বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না।
তিনি গত ১৫ আগস্ট প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিআরটিএর পাশাপাশি
যাত্রীদের এসব অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। তাদের অপরাধের বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ
সংগ্রহ করে আমাদের কাছে জমা দিলে আমরা ওই নির্দিষ্ট পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে
পারব। যাত্রীরা প্রমাণ হিসেবে বাসের টিকিট অথবা কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করে
অভিযোগ করতে পারেন।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
ড. সামছুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মালিক সমিতি এটাকে চালু করেছিল, তারা রোগের
চিকিৎসা না করে উপসর্গের চিকিৎসা করতে গিয়েছে। সে কারণে কোনো টেকসই ফলাফল পাওয়া যায়নি।
আসলে বাসগুলো লিজ সিস্টেমে চালক ও হেলপাররা পরিচালনা করেন। মালিক শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ
টাকা পান। সেজন্য গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাসগুলোকে একটি কোম্পানির আওতায় এনে
পরিচালিত করতে হবে।
কীভাবে করা যায়? জবাবে তিনি বলেন, হাতিরঝিলে যেভাবে বাস চলছে, সেখানে
বাসগুলোর মধ্যে নেই কোনো প্রতিযোগিতা এবং ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডা। ঠিক এভাবে গণপরিবহন
চালু করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘গণপরিবহনে একটি বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। তারাই মূলত
রাজধানীসহ সারা দেশের গণপরিবহনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি যারা ই-টিকিট চালু করেছিল
তারা আলোচিত হওয়ার জন্য এগুলো করেছিল। তাই সঠিক ও টেকসই পরিকল্পনা করতে পারলে সেখানে
আর কোনো সমস্যা থাকবে না। বরং চালক ও হেলপার মানসম্মত বেতন পাবেন এবং যাত্রীরাও নিরাপদে,
সঠিক ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন।’