মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন
শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:১৭ পিএম
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:০৬ এএম
‘ও আল্লাহ গো আমারে কোন জায়গায় দাঁড় করাইয়া দিলা। আমার জীবনডা যে উল্টাপাল্টা হয়ে গেল।’ স্বামীর লাশের অপেক্ষায় মর্গের সামনে এভাবেই বিলাপ করছিলেন সাজনা আক্তার। কোলে তার আড়াই বছরের মেয়ে। মুখ মলিন করে মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, দুই শিশুসন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন তিনি।
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান স্বামী পোশাককর্মী খোকন মিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার (২০ ডিসেম্বর) বিকালে খোকনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। লাশবাহী গাড়িতে স্বামীর মরদেহ নিয়ে যান সাজনা আক্তার। সঙ্গে ছিল ছোট্ট মেয়ে শারমনি ও অন্য স্বজনরা। তাদের কোনো সান্ত্বনাই মন শান্ত করতে পারছে না সাজনার। বৃদ্ধ মা ও দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন খোকন। সেখান থেকে মা-মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। আর আট বছর বয়সি ছেলে আবু তালহাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামে মামাবাড়ি রেখে এসেছিলেন। সেদিন অন্যদিনের মতোই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন নেত্রকোণা সদর, ময়মনসিংহ, গফরগাঁও হয়ে ঢাকার কমলাপুরে ফিরছিলেন তারা। সবশেষ স্টপেজ কমলাপুরের আগে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়ায় ট্রেনটি। এখানেই নেমে যায় বেশিরভাগ যাত্রী, নতুন করে ওঠেও অনেকে। ভোর ৫টার কয়েক মিনিট আগে খিলক্ষেত এলাকা পার হওয়ার সময় ঘটে বিপত্তি। ট্রেনটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তখন বৃদ্ধা মাকে জানালা দিয়ে বাইরে নিরাপদে বের করে আনেন খোকন। এরপর ছোট্টা মেয়েকে বের করে মায়ের কোলে দেন। পরে মালামাল নামানোর জন্য আবারও ট্রেনে ওঠেন তিনি। কিন্তু আর ফেরেননি।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুনের কারণ এখনও উদঘাটন হয়নি। এ ঘটনায় ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছে পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রেলওয়ে পুলিশ, র্যাব, থানা-পুলিশ, সিআইডিসহ সাতটি সংস্থা তদন্ত করছে। ভিডিও ফুটেজ যাচাইয়ে তিনজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তারা ২ শতাধিক সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে জেনেছেন, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পার হওয়ার পর সৈনিক ক্লাব থেকে নাখালপাড়া এই স্থানের মধ্যে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছাতে সময়ের হিসাবে দূরত্ব ১৮ মিনিটের। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনটিতে আগুন দেখা যায়নি। কিন্তু তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছার আগে টের পাওয়া যায় ট্রেনে আগুন লেগেছে।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের সহকারী মাস্টার মো. পর্বত আলী বলেন, তেজগাঁও স্টেশনে এলে আমরা দেখতে পাই পেছনের তিনটি বগি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। নাখালপাড়া ফকিন্নি বাজার রেল ক্রসিংয়ের গেটম্যান হোসাইন বলেন, ‘আমি রেল ক্রসিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চলন্ত ট্রেনটির শেষের কয়েকটি বগি থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছিলাম। তবে ভালো করে আগুন লাগতে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছে ট্রেনের ভেতরে থাকা ব্যক্তিরাই আগুন দিয়েছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘কাউকে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নামতে দেখি নাই বা বাইরে থেকে কাউকে কিছু ছুড়ে মারতেও দেখি নাই।’
ট্রেনে আগুনের ঘটনায় মামলা
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) খালেদ মোশারেফ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে বলা হয়েছে, ট্রেনটি গত সোমবার রাত ১১টায় মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। মঙ্গলবার ভোরে ট্রেনের ভেতর ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে যাত্রীরা চিৎকার করেন। কর্তব্যরত স্টুয়ার্ড ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই ট্রেন তেজগাঁও রেলস্টেশনে প্রবেশের সময় মোবাইল ফোনে ট্রেনটির এলএম দীলিপ কুমার মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ থামানোর ব্যবস্থা করা হয়। থামানোর পর আগুন লাগা তিনটি বগি অন্যান্য বগি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফায়ার সার্ভিস এসে ‘জ’ বগিতে অগ্নিদগ্ধ চারজনের লাশ পায়। এজাহার অনুযায়ী, দুষ্কৃতকারীরা পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়েছে।
এজাহার বিষয়ে ঢাকা রেল পুলিশের সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, মামলায় অজ্ঞাত আসামি, চারজনকে পুড়িয়ে হত্যা, একজনকে আহত এবং তিন কোটি টাকা ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রেনে নিরাপত্তায় তিনজন পুলিশ ছিলেন। তারা সব সময় এক জায়গায় বসে থাকেন না। ট্রেনের ভেতরে তারা রানিং অবস্থায় থাকেন। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কেরোসিনের গন্ধ পেয়েছিলেন যাত্রীরা
আগুন দেওয়ার পর বগিতে থাকা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে পুলিশ কথা বলেছে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, আগুন লাগার সময় যাত্রীরা কেরোসিনের গন্ধ পেয়েছিলেন। সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান ঢাকা রেল পুলিশের সুপার আনোয়ার হোসেন।
যেসব ক্লু নিয়ে মাঠে গোয়েন্দারা
সূত্র বলছে, সিসি টিভি ফুটেজ দেখে আগুন লাগা বগিগুলোর যাত্রী, রেলকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন তদন্তকারীরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত কোথায় হয়েছে, সেটি কিছুটা আন্দাজ করা গেছে। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পরই সূত্রপাত হয়েছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে ১২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া তেজগাঁও স্টেশনের দুটি এবং গফরগাঁও রেলস্টেশন থেকে একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
দুজনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর
আগুনে নিহত খোকন মিয়া ও রশিদ ঢালীর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। খোকন মিয়ার মরদেহ তার স্ত্রী সাজনা আক্তার ও রশিদ ঢালীর মরদেহ তার ছেলে মামুনের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের এসআই সেতাফুর রহমান জানান, দুই পরিবারের স্বজনরা লাশ শনাক্ত করেছে। খোকনের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায়।
সাজনা বলেন, ‘ভাতিজির বিয়ের জন্য আমার শাশুড়ি ও ছোট মেয়েকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার খোকন গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে যায়। সোমবার রাতে ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। রাত ৯টার পর তার সঙ্গে আর আমার কথা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘পরে জানতে পারলাম ট্রেনে আগুন লেগে চারজন মারা গেছে। কিন্তু আমি আমার স্বামীর মোবাইলে অনেকবার ফোন দিয়েছি। কল যায়নি। পরে মর্গে এসে দুটি মরদেহ দেখি। এর মধ্যে একটি আমার স্বামীর।’
নিহত আরেকজন হচ্ছে রশিদ ঢালী। তার ভাতিজা মো. বেলাল আহমেদ বলেন, ‘খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল মর্গে এসে চাচার মরদেহ শনাক্ত করি। পরে তার ছেলে মামুন এসেও চাচার মরদেহ শনাক্ত করে। ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ আমাদের কাছে চাচার মরদেহ হস্তান্তর করেছে। চাচার মরদেহ নেত্রকোণার বাড়িতে নিয়ে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।’ এর আগের দিন অন্য দুজনের লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ।