সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:১৬ এএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৫৮ এএম
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অমর একুশে বইমেলায় উপচে পড়া ভিড়। প্রবা ফটো
ভাষা আন্দোলন আর ভাষাশহীদদের স্মরণ করার একুশের বিকালে বইমেলায় নেমেছিল যেন প্রাণের জোয়ার। পলাশ ফোটা শিমুল রাঙা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এমন চিত্রই ছিল বুধবার।
শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর পেরিয়ে বিশাল জনসমুদ্রের স্রোত আছড়ে পড়েছে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেই জনস্রোতে মিশে ছিল বইয়ের জয়জয়কার। শ্রদ্ধার ফুলটি রেখে স্টল ও প্যাভিলিয়নের সামনে বইপ্রেমীদের ভিড়ে অন্যরকম এক ভালো লাগা ছিল মেলাজুড়ে। যে হাতে শ্রদ্ধার ফুলটি রাখা হয়েছিল শহীদ মিনারে, মেলায় এসে সেই হাতেই শোভা পেয়েছিল বই।
বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সবার হাতে হাতে ছিল ব্যাগভর্তি বইয়ের সমারোহ। বিকিকিনিতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
সকাল ৮টায় মেলার প্রবেশদ্বার খোলার পর থেকেই বইপ্রেমীরা ভিড় জমায় মেলার দুই প্রাঙ্গণে। সকালের সেই ভিড় বিকালে রূপ নেয় জনসমুদ্রে। আর সেই জনসমুদ্রের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বই কিনেছিল বইপ্রেমীরা। এই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বইয়ের কাটতি ভালো ছিল বলেও জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
বিভিন্ন স্টলে নিজেদের ভক্ত লেখকদের অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন দেশের নামকরা লেখকরাও। অনন্যা প্রকাশনীতে ইমদাদুল হক মিলন, প্রথমায় আনিসুল হক, অনিন্দ্য প্রকাশে কলকাতার জনপ্রিয় কবি রুদ্র গোস্বামী, অন্যধারায় শাহাদাত হোসেনসহ অনেক লেখক ব্যস্ত ছিলেন পাঠকদের সঙ্গে।
বাংলাদেশের বইমেলা কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নে রুদ্র গোস্বামী বলেন, ‘ভালোবাসা পেলে ভালো কথা বলে মানুষ/ভালো কথা পেলে ভালোবাসে। আমি ভালো কথা ও ভালোবাসা আদান-প্রদান করতে আসি। খুব ভালো লাগছে।
বাংলাদেশ ও কলকাতার বইমেলার মধ্যে প্রার্থক্য কী? এমন প্রশ্নের জবাবে রুদ্র গোস্বামী বলেন, এবারই প্রথম নয়, আমি ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের বইমেলায় আসছি। কলকাতার বইমেলা শেষে দুদিন অবসর কাটিয়ে ঢাকার বইমেলায় আসি। আমার কাছে বইমেলা হচ্ছে উৎসব। মানুষের হৃদয় বা মনের কোনো জেন্ডার নেই। বাংলাদেশ আর কলকাতা বইমেলা তেমন, জেন্ডারলেস। আমার কাছে কোনো পার্থক্য নেই।
মেলায় স্ত্রী ও পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চাই মেয়েকে। দুপুরে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। সেখানে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোরাঘুরি করে এলাম বইমেলায়। বইমেলা তাকে ঘুরে দেখাব। কিছু বইও কিনে দেব।
মেলায় বন্ধুদের নিয়ে এসেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিলা হক। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছি। এরপর বন্ধুদের নিয়ে মেলায় এলাম। পছন্দের সব লেখকের বইয়ের তালিকা আগেই করে রেখেছি। আজ তালিকা ধরে সব বই কেনার চেষ্টা করব।
কথা প্রকাশের ব্যবস্থাপক মো. ইউনুছ বলেন, আজ মেলাকে প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে। অনেক পাঠক-দর্শনার্থী এসেছেন। কেউ বই কিনছেন, কেউ ঘুরে দেখছেন। তবে খুশির খবর হলো আজ ভাষা আন্দোলনের বইয়ের প্রতি মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ দেখেছি।
দেশ প্রকাশনের প্রকাশক অচিন্ত্য চয়ন বলেন, এবারের বইমেলা জমজমাট। গত কয়েক বছর করোনার ভয় ছিল। তবে এবার সেটা কাটিয়ে উঠেছে মানুষ। অন্যান্য দিনের চেয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি হওয়ায় আজ মেলায় ভিড় বেশি। এবার সন্তুষ্টির জায়গাটাও রয়েছে প্রকাশক হিসেবে।
ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, বইমেলার সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িত। মানুষ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মেলায় ঢু মারছে। পাঠকের উপস্থিতির তুলনায় বিক্রিও ভালো।
বুধবারের নতুন বই
বুধবার নতুন বই এসেছে ২৩৪টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে সৌম্য প্রকাশনী এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি’। র্যামন পাবলিশার্স এনেছে আনিসুল হকের গল্পগ্রন্থ ‘অমাবস্যার রাতে কে এসেছিল’। কথাপ্রকাশ এনেছে মোহাম্মদ হান্নানের গবেষণা ‘বাঙালি মুসলমানের প্রত্যুষকাল’। পাঠক সমাবেশ এনেছে সাহাদাত পারভেজ রচিত জীবনীগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী: একজন সাইদা খানম’। আদিগন্ত প্রকাশন এনেছে সুজন বড়ুয়ার উপন্যাস ‘ভোরের সূর্যমুখী’। অন্যপ্রকাশ এনেছে ফরিদুর রেজা সাগরের গল্প ‘তারপরও হাফডজন ছোটোকাকু’ এবং স্বকৃত নোমানের প্রবন্ধ ‘যুবতী রাধে, সৈয়দ হক ও আরও কথা’। ঐতিহ্য এনেছে আসাদুজ্জামান নূরের আত্মজীবনী ‘নিরালা নীলে’। খুশবু প্রকাশন এনেছে লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া ‘বেড়াল ছানা ফোন করেছে কুকুর ছানার মাকে’। বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে রুমানা বৈশাখীর গল্প ‘তোমায় আমি মন্দবাসি’। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স এনেছে অমিত গোস্বামীর উপন্যাস ‘অগ্নিপথের পথিক’ ও সঙ্গীতা ইমামের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ‘হারায় যা তা হারায় শুধু চোখে’।
মেলা মঞ্চের আয়োজন
সকাল ৮টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। স্বরচিত কবিতা পাঠে প্রায় ১৩৫ কবি কবিতা পাঠ করেন। সভাপতিত্ব করেন কবি শামীম আজাদ। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা ২০২৪। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. সরকার আমিন। অমর একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির সচিব ড. মো. হাসান কবীর।
আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, বাঙালি জাতির কাছে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এখন আর একটি নামমাত্র নয়, বাঙালি জাতির পথ চলবার এক নিরন্তর অনুপ্রেরণা, এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। সমাজের কল্যাণের স্বার্থে মুসলিম নারীর শোচনীয় এবং অধঃপতিত অবস্থা সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন তিনি। প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েই সংগ্রাম করে তিনি জীবনের পথে, কর্মের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন।
বইমেলার মূলমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, আমিনুর রহমান সুলতান, হাসানাত লোকমান, বদরুল হায়দার, ফারহানা রহমান, সঞ্জীব পুরোহিত, নূর-এ-জান্নাত, শিমুল পারভীন এবং আরেফিন রব। এ ছাড়াও সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, শিবু রায়, মহাদেব ঘোষ, মিথুন জব্বার, বাবু জব্বার, আব্দুল হালিম খান, স্বর্ণময়ী মণ্ডল এবং জান্নাত-এ-ফেরদৌসী।
আজকের আয়োজন
আজ বৃহস্পতিবার, বইমেলার ২২তম দিন। মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: আসাদ চৌধুরী এবং স্মরণ: জাহিদুল হক’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন যথাক্রমে মাহমুদা আকতার এবং কামরুল হাসান। কবি ড. মুহম্মদ সামাদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন দিলারা হাফিজ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, খালেদ হোসাইন এবং মনি হায়দার।