কলেজছাত্রী ধর্ষণ ও হত্যা মামলা
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪ ২১:৪৪ পিএম
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪ ১৫:২০ পিএম
বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর ও কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া। ছবি : সংগৃহীত
কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা মামলায় এত আলামত থাকার পর কীভাবে মূল আসামিসহ অন্যদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। বিচারকের সঙ্গে একমত পোষণ করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী।
মুনিয়ার মরদেহের ময়নাতদন্ত ও সংগৃহীত আলামতের ডিএনএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার পোশাকে পুরুষের স্পার্ম পাওয়া গেছে। বাদীর আইনজীবীর পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে, স্পার্ম পাওয়ার বিষয়টি যেহেতু স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সেহেতু ওই স্পার্ম বসুন্ধরার এমডি ও মামলার প্রধান আাসামি সায়েম সোবহান আনভীরের। কারণ ওই বাসায় তিনি ছাড়া অন্য কারও যাতায়াতের কোনো সুযোগ ছিল না। তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তেও এটা প্রমাণিত হয়েছে, একমাত্র সায়েম সোবহান আনভীরই ওই ফ্ল্যাটে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। অথচ প্রতিবেদনের শেষ অংশে তারা বলেছে—অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। সুতরাং পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে ব্যাপক গরমিল রয়েছে।
রবিবার (১০ মার্চ) নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে বাদীর নারাজি আবেদনের ওপর শুনানি হয়। এ সময় মুনিয়ার বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহানের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত। বাদী জবানবন্দিতে বলেছেন, শুধু তার বোন মুনিয়াকেই নয়, মুনিয়ার গর্ভে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের যে সন্তান ছিল, অনাগত সেই সন্তানকেও হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ তদন্তে পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শুনানি শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
বহুল আলোচিত কলেজছাত্রী মুনিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগে ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর মামলা করেন নুসরাত জাহান। মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর, তার বাবা আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমসহ আটজনকে আসামি করা হয়। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পিবিআইকে। তারা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এই প্রতিবেদনে সব আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন নারাজির আবেদন করেন বাদী। ওই আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য ছিল রবিবার। বাদীপক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন। তার সঙ্গে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন, মো. ওমর ফারুকসহ কয়েকজন। অপর দিকে আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মাহবুব হোসেন, ফিরোজুর রহমান মন্টু, আসাদুজ্জামান ও তুহিন হাওলাদার।
এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক মামলার নথি পর্যালোচনা করে ২০ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন। পরে ১০ দিন এগিয়ে এনে সেই তারিখ ১০ মার্চ ঠিক করা হয়।
শুনানি শেষে বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত মাসের ৭ ফেব্রুয়ারি মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্তে পিবিআই আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেই প্রতিবেদনের নারাজির শুনানি হয়। শুনানি শেষে ২০ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছিল। পরে সেই শুনানি ১০ দিন এগিয়ে দেন আদালত। রবিবার নির্ধারিত সময়ে শুনানি হয়েছে। আমরা কেন পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের বিপক্ষে নারাজি দিয়েছি, সেই যুক্তিগুলো আদালতের কাছে পুনরায় তুলে ধরেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালত কার্যবিধির ২২ ধারায় বাদীর জবানবন্দি নিয়েছেন। আমরা শুনানিতে বলেছি, পিবিআই যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে ব্যাপক গরমিল রয়েছে। এজাহারে যা ছিল আর পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। অনেক কিছুই তারা পরিষ্কার করেনি। ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিকটিম মুনিয়াকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তার অন্তর্বাস ছেঁড়া ছিল। গোপনাঙ্গে আঘাতজনিত চিহ্ন পাওয়া গেছে। পাশাপাশি রক্তপাতও ছিল। এগুলো জোরপূর্বক ধর্ষণের কারণে হয়েছে। যে কারণে মেয়েটির পোশাকে পুরুষের স্পার্ম (শুক্রাণু) পাওয়া গেছে। ধর্ষণের জন্য ধস্তাধস্তি করলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।’
শুনানিতে আইনজীবী আরও বলেন, ‘পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে—মুনিয়ার মরদেহ যে বাসা থেকে উদ্ধার হয়েছে, ওই বাসায় একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তাই আমরা মনে করি, মুনিয়ার পোশাক ও বিছানায় যে স্পার্ম পাওয়া গেছে তা একমাত্র বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের। পিবিআইয়ের তদন্তেই মামলার অভিযোগ (মুনিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা) প্রমাণিত হয়ে গেছে। কিন্ত তারা প্রতিবেদন শেষে উল্লেখ করেছে—ধর্ষণ ও হত্যার কোনো প্রমাণ পায়নি; যা পরস্পরবিরোধী। এ কারণে আমরা আদালতের কাছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২৭ ধারায় মামলা সরাসরি এজাহারভুক্ত করার নির্দেশনা চাইছি। যা আপনি (বিচারক) দিতে পারেন।’
আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আদালত আমাদের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিচারক বলেছেন, এত কিছুর পরও কীভাবে সব আসামিকে বাদ দিয়ে মামলার এফআরটি (ফাইনাল রিপোর্ট) হয়? আমাদেরও একই প্রশ্ন ছিল আদালতের কাছে। আমরা বিশ্বাস করি, ২৭ ধারায় মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটি থানায় এজাহারভুক্ত করার আদেশ পাব। আশা করি, বিচারক আমাদের আবেদন আমলে নিয়ে মামলার আদেশ দেবেন। আদালত মামলাটির বিষয়ে আদেশ দেওয়ার জন্য ২০ মার্চ তারিখ নির্ধারণ করেছেন।’
নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. রেজাউল করিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘শুনানির সময় বাদীপক্ষের আইনজীবী মামলার তদন্তকারী সংস্থার প্রতিবেদনের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন। একপর্যায়ে বাদীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য শুনে বিচারক বলেন, তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের কাছে এটা আশা করিনি। এত প্রমাণ থাকার পরও তদন্তকারী কর্মকর্তা কীভাবে সব আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন!’
শুনানি শেষে বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া বলেন, ‘আদালত আজ আমার জবানবন্দি নিয়েছে। ২৬ এপ্রিল ২০২১ সালে আমার বোন মোসারাত জাহান মুনিয়াকে হত্যা করা হয়, সেটি আমি আদালতকে বলেছি। আমি ওই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আদালতকে জানিয়েছি। আমি বলেছি, এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া পিবিআই আসামিপক্ষের কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে একটি ফরমায়েশি প্রতিবেদন দিয়েছে। আমি সেই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কেন নারাজি দিয়েছি, সেটিও বিস্তারিত বলেছি। আদালত আমার বক্তব্য শুনেছেন। আমি আশা করছি, আদালতের কাছে আমি ন্যায়বিচার পাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতকে বলেছি, মুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ওই সন্তান সায়েম সোবহান আনভীরেরই ছিল। এখানে শুধু মুনিয়াকে নয়, আরও একটি জীবন হত্যা করা হয়েছে। পিবিআই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। এখানে আসামিপক্ষ অনেক প্রভাবশালী। প্রভাবশালীদের কোনো বিচার হয় না। তবুও আমি আশা করছি, ন্যায়বিচার পাব।’
বাদীপক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ, এ মামলার পর যতগুলো শুনানি হয়েছে প্রতিটি শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা শুনানিতে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করেছেন। রবিবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আসামিপক্ষে হাজির ছিলেন ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সদ্যনির্বাচিত সভাপতি আব্দুর রহমান হাওলাদার। নারাজি পিটিশন শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীর কথা বলার সুযোগ কম। তা সত্ত্বেও তারা শুনানিতে নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।’
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল গুলশানে জনৈক ইব্রাহিম আহমেদ রিপনের বাড়ির ফ্ল্যাট থেকে কলেজছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ফ্ল্যাট থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, সেখানে মুনিয়ার সঙ্গে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের প্রেম, বিয়ের আশ্বাস, শারীরিক সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে লেখা ছিল। ওই সময় গুলশান থানায় মুনিয়াকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে আনভীরকে আসামি করে একটি মামলা হয়। কিন্তু সেই মামলায় আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে গুলশান থানা পুলিশ ১৯ এপ্রিল চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ১৮ আগস্ট ওই মামলায় পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদন গ্রহণ করেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী ওই সময় পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মুনিয়ার পরিবারের করা অনাস্থার আবেদনও খারিজ করে দেন। পরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এ মামলা করেন মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। সেই মামলায় অভিযোগ ছিল, মুনিয়াকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। মামলায় অন্য আসামিরা হলেন, আনভীরের মা আফরোজা বেগম, আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, আনভীরের বাবা আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলম, শারমিন আহমেদ রাখি (বাড়ির মালিকের স্ত্রী), আনভীরের বান্ধবী সাইফা রহমান মীম, কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও বাড়ির মালিক ইব্রাহিম আহাম্মদ রিপন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই ঢাকা মেট্টো দক্ষিণের অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ।