কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৩৮ এএম
আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৫৮ পিএম
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী সাবরেজিস্ট্রার অফিসে এসে বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে অনেককে। প্রবা ফটো
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ে সাবরেজিস্ট্রি কর্মকর্তা ও দলিল লেখক সমিতির দ্বন্দ্বে দুই মাসের বেশি সময় ধরে জমি দলিল সম্পাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন জমি ক্রেতা-বিক্রেতারা। একই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দলিল লেখক, স্ট্যাম্প বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট ৫ শতাধিক মানুষ। সরকারি ফি সংগ্রহ নিয়ে কর্মকর্তা ও দলিল লেখক সমিতির দ্বন্দ্বের কথা বলা হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে অতিরিক্ত আদায় করা অর্থ ভাগবাটোয়ারার ঝামেলা।
কার্যালয় ও দলিল লেখকদের তথ্যমতে, নাগেশ্বরী সাবরেজিস্ট্রার অফিসে সপ্তাহের মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতিবার এ তিন দিন দলিল সম্পাদন করা হতো। অফিসের আগের কর্মকর্তা অবসরে গেলে ২১ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত দায়িত্ব পান উলিপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি কর্মকর্তা নাবীব আফতাব। তিনি এখানে যোগদানের পর দলিল লেখকদের কিছু শর্ত জুড়ে দেন। কিন্তু দলিল লেখক সংগঠনের নেতারা সে শর্তে রাজি না হওয়ায় যোগদানের দুই দিন পর দলিল সম্পাদন বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা। দলিল সম্পাদন না হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় জমির কেনাবেচা। এতে জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা পড়েছেন মহাবিপাকে। দূরদূরান্তের লোকজন বিষয়টি না জেনে একাধিকবার অফিসে এসে ফিরে যাচ্ছেন। এতে আর্থিক ক্ষতিতে পড়ছে মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের তিন দিন অফিস চত্বর শত শত মানুষের পদচারণে মুখর থাকত। অফিস ঘিরে বেশকিছু ছোট ছোট দোকানে দিনভর মানুষের ভিড় থাকত। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় ধরে চত্বরটি সুনসান। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে।
অফিস চত্বরে গিয়ে কথা হয় উপজেলার নেওয়াশী ইউনিয়নের হরিনাশ চন্দ্রের সঙ্গে। তিনি চার দিন থেকে ঘুরছেন জমি রেজিস্ট্রি করতে। কিন্তু কর্মকর্তা না থাকায় প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছেন।
হরিনাশ চন্দ্র বলেন, ‘আমার খুব সমস্যা। টাকার দরকার। এজন্য জমি বিক্রি করতে হচ্ছে। জমি রেজিস্ট্রি না দিলে ক্রেতা টাকা দিচ্ছে না। আমার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।’
জমি কিনতে আসা একই এলাকার রবিনাশ চন্দ্র বলেন, ‘আমরা কয়েকদিন থেকে এসে ঘুরে যাচ্ছি। যার জমিটা কিনব তিনিও আসতেছেন আমার সঙ্গে। তার টাকার খুব দরকার। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি করতে না পারায় তাকে টাকা দিতে পারছি না। শুধু বলছেন আগামী সপ্তাহে হবে। কয়েক সপ্তাহেও হলো না।’
একই অভিযোগ শোনা গেছে বেশ কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে। অনেকে টাকার অভাবে অন্য কিছু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। দলিল সম্পাদন না হওয়ায় সাধারণ দলিল লেখক, স্ট্যাম্প বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টদের আয় বন্ধ হওয়ায় অন্য কাজে চলে গেছেন অনেকে।
চত্বরের ছোট ঘরে বসে আছেন মোকছেদুল হক মণ্ডল। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ অফিসে স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন তিনি। তার আয় বলতে এটাই। কিন্তু দুই মাস ধরে স্ট্যাম্প বেচাকেনা হচ্ছে না। এতে পরিবার নিয়ে পড়েছেন অভাবে। তিনি বলেন, ‘এ জীবনে এমন ঘটনা প্রথম দেখলাম। মানুষের খুব সমস্যা হচ্ছে। আমাদের অনেকে রিকশা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ অন্যের দোকানে চাকরি নিয়েছেন।’ বেশ কয়েকজন দলিল লেখক জানান, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পরিবারের খরচ চালাচ্ছেন তারা। এ ছাড়া উপায় নেই।
দলিল সম্পাদন বন্ধের বিষয়ে খোঁজ নিতে অফিসে গিয়ে পাওয়া যায়নি সাবরেজিস্ট্রি কর্মকর্তা নাবীব আফতাবকে। তবে অফিস সহকারী সুরেশ চন্দ্র সেন জানান, দলিল সম্পাদনে যেসব সরকারি ফি রয়েছে সেসব ফি দলিল লেখকদের অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে বলেছেন বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার। দলিল লেখকরা তাতে রাজি না হওয়ায় তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন।
দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘সরকারি ফি অফিসের ভেতরে সংগ্রহ করার নিয়ম। কিন্তু কর্মকর্তা বাইরে নিতে বলছেন। এটা নিয়মবহির্ভূত। আমরা তা করব না।’
শামীম আরও জানান, দলিল লেখকরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
তবে দলিল সম্পাদন বন্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিলেছে অন্য খবর। জানা গেছে, প্রতিটি সম্পাদনকৃত দলিলের বিপরীতে সরকারি ফি ছাড়াও আদায় করা বাড়তি টাকা ভাগাভাগি নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া দলিল সম্পাদনে কাগজপত্র যাচাই নিয়েও রয়েছে মন কষাকষি। একাধিক দলিল লেখক বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি লাইসেন্স বাতিলের ভয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, সম্পাদনকৃত প্রতিটি দলিলে নির্ধারিত সরকারি ফি ব্যাংকে জমা করা হয়। এর বাইরে প্রতি দলিলে কর্মকর্তাকে বাড়তি এক হাজার টাকা দিতে হতো। এর জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চার-পাঁচ হাজার টাকা বেশি নিতেন দলিল লেখকরা। সমিতির নেতাদের মদদে এসব হতো। বিভিন্ন হিসাব দেখিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাকে বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য করা হতো। এ টাকা আদায় হতো দলিল লেখক ও অফিস সহকারীর মাধ্যমে।
তারা জানান, কর্মকর্তা নাবীব আফতাব যোগদানের পর বাড়তি ফি এক হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার দাবি করেন তিনি। একই সঙ্গে সব ফি অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে বলেন দলিল লেখকদের। কাগজপত্রেও কড়াকড়ির নির্দেশ দেন নাবীব আফতাব।
কিন্তু দীর্ঘদিনের নিয়ম ভেঙে এতে রাজি হননি দলিল লেখক সমিতির নেতারা। বাড়তি টাকাতে সমিতির আপত্তি না থাকলেও অফিসের বাইরে সংগ্রহ করতে নারাজ সমিতি। অন্যদিকে বাড়তি উৎকোচ দিলে কাগজপত্র যাচাই শিথিল চান তারা। এতে রাজি ছিলেন না কর্মকর্তা নাবীব আফতাব।
যদিও দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আলী আজম প্রধান দাবি করেছেন, বাড়তি টাকার বিষয় নেই এখানে। বাড়তি টাকা নেওয়া হয় না। তাদের আমলে নেওয়া হবে না। সরকারি ফি সংগ্রহ নিয়ে এ জটিলতা বলে দাবি তার।
তিনি বলেন, দুই মাসে অনেক দলিল লেখক নিঃস্ব হয়েছেন। এখানে স্থায়ী কর্মকর্তা এলে সমস্যা সমাধান হবে।
যদিও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘একেক কর্মকর্তার একেক আশা থাকে। একেক দাবি থাকে। সব পূরণ করা সম্ভব নয়।’
সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মোহরার আতাউর রহমান জানান, ওই অফিসে মাসে সাতশ থেকে এক হাজার দলিল সম্পাদন হতো। এ সমস্যার কারণে বিশেষভাবে কিছু দলিল সম্পাদন হচ্ছে। এর মধ্যে চলতি নভেম্বরে মাত্র পাঁচটি দলিল সম্পাদন হয়েছে। অক্টোবরে সম্পাদন হয়েছে ৬৪টি দলিল। তারও দাবি, ‘স্যার এসে কড়াকড়ি করেছেন। টাকা বাইরে নেওয়ার কথা বলেছেন। এখানে অন্য কিছু নেই।’
এ বিষয়ে চার দিন ধরে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সাবরেজিস্ট্রার নাবীব আফতাব কল রিসিভ করেননি। মেসেজ করলেও সাড়া দেননি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা জাহান বলেন, ‘বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ। যেহেতু মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে তাদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সমাধান করা হবে।’
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ‘তাদের দুই পক্ষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে নতুন কর্মকর্তা দেওয়া হবে।’