ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিমা ভাঙচুর
ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:৫৮ এএম
আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:০১ এএম
বালিয়াডাঙ্গীর তিনটি ইউনিয়নে ১৪টি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ধনতলা ইউনিয়নে নয়টি, চাড়োল ইউনিয়নে একটি ও পাড়িয়া ইউনিয়নে চারটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রবা ফটো
‘শনিবার মুই সন্ধ্যা বাতি ধুনা জালায় আসিনু হামার লক্ষ্মী মন্দিরটাত। সকাল যায় দেখেছু লক্ষ্মী প্রতিমাটা ভাঙে পড়ে আছে। শুধু লক্ষ্মী প্রতিমাটা না, পাশের বুড়া-বুড়ির মন্দিরের প্রতিমালাও ভাঙিছে। যারা রাইত এই খারাপ কামখান করিছে উমার কী ভয় লাগেনি? লোকলা কীভাবে পাড়িছিল হামার ভগবানলা ভাঙিবা? কেহ না দেখোক ভগবান তো দেখিছে, ভগবান উমার বিচার করিবে।’ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা গীতা রাণী।
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে বালিয়াডাঙ্গীর তিনটি ইউনিয়নে ১৪টি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ধনতলা ইউনিয়নে নয়টি, চাড়োল ইউনিয়নে একটি ও পাড়িয়া ইউনিয়নে চারটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। শংকা প্রকাশ করে পাড়িয়া ইউনিয়নের গীতা রাণী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক লোক ভয়ে মন্দিরে ভাঙা প্রতিমালা দেখিবা আসেনি। যদি কেউ বাড়ি-ঘরলাত হামলা করে। ভগবান সবার বিচার করিবে।’
যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক। এসব এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ধনতলা ইউনিয়নের সুরকেশ রায় বলেন, ‘আমার বয়স ৪০ বছর। জীবনের প্রথম এমন ঘটনা ঘটল আমাদের এলাকায়। ছোট থেকে বড় হইছি, হিন্দু-মুসলমান সবাই ভাইয়ের মতো হয়ে চলছি। কোনোদিন ধর্ম নিয়ে কোনো ভেদাভেদ হয়নি। সবাই মিলেমিশে সবার ধর্ম পালন করছি।’
প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের বিচার চেয়ে সুরকেশ বলেন, ‘যারা এইসব নোংরামি কাজ করেছে তাদের পুলিশ খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি যেন দেয় এটাই চাওয়া।’
এদিকে এ ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতার শংকা প্রকাশ করে চাড়োল ইউনিয়নের প্রমর্থ রায় সিংহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে ওঠে শুনি আমাদের কালী মন্দিরে কালীমাকে ভেঙে ফেলে দিছে। এসে দেখি বিভিন্ন টুকরা ভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা যার পূজা করি যাকে ভগবান মানি তার নিরাপত্তা নাই, তাহলে আমাদের হিন্দুদের কী অবস্থা হবে? আমরা হিন্দু সমাজের মানুষরা কীভাবে এখানে থাকব? আমরা সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছি। এরপর যে কী হবে এটা নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত।’
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের ধনতলা ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক যতীন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমাদের এবং আমাদের বাপ-দাদার আমলে কোনোদিন ঘটেনি। সিন্দুরপিণ্ডি থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন মন্দিরে ১০টা প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনা খুব দুঃখজনক। এটা শুধু আমরা না, যেকোনো ধর্মে কেউ এমন ঘটনা মেনে নিবে না। যারা এই জঘন্য কাজটি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি আমি।’
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিদ্যানাথ বর্মণ বলেন, ‘তিনটি ইউনিয়নে মোট ১৪টি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দূর্বৃত্তরা। সবচেয়ে বেশি ধনতলা ইউনিয়নে। প্রতিমাগুলোর হাত-পা, মাথা ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। আবার কিছু প্রতিমা ভেঙে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমি চাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দোষীদের বিচার হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।’
এ বিষয়ে বালিয়াডাঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল আনাম ডন বলেন, ‘তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের পুলিশ ফোর্স মোতায়ন করা হয়েছে। সারা রাত টহলে রয়েছে।’
ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা গ্রামগুলোতে রাতে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করেছি।’