× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গেরিলা থেকে সম্মুখযোদ্ধা তবিবুর

রাজু আহমেদ, রাজশাহী

প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:১৮ পিএম

মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান।ছবি: প্রবা

মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান।ছবি: প্রবা

তবিবুর রহমান সব সময় সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। তিনি শত্রুর সামনে অকুতোভয়, নিপীড়িত মানবতা বা বিপর্যস্ত পরিবেশে আস্থার প্রতীক আর অসাম্য প্রতিরোধ বা প্রতিবাদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জীবিত প্রভা। তার একমাত্র পরিচয়- তিনি রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা।

৭০ বছর বয়সি তবিবুর এখনও চালচলন আর মননে পুরোদস্তুর যুবক। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একাধিকবার গর্জে উঠেছেন অস্ত্র হাতে। প্রথম দিকে তিনি গেরিলা আক্রমণ করলেও শেষ দিকে ভারী অস্ত্র নিয়ে শত্রুসেনাদের মুখোমুখি হন। সেসব যুদ্ধে তিনি যেমন পাকিস্তানিদের ঘায়েল করেছেন, তেমনি চোখে দেখেছেন সহযোদ্ধাদের শহীদ হতে।

আজ তুলে ধরব মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমানের অগ্নিঝরা একাত্তরের রণাঙ্গনের বীরত্বগাথা। তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিদিনের বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের।

তবিবুর রহমান বলেন, আমি ১৯৭০ সালে গোদাগাড়ী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি। ১৯৭১ সালের মার্চে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এপ্রিল থেকেই এ যুদ্ধে সম্পৃক্ত হই। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের লালগোলায় নাম লেখাই এবং ১ মে থেকে সেখানে এক মাস ১৭ দিন ট্রেনিং নেই। জুনের মাঝামাঝিতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরি। 

ফিরে জানতে পারি, দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানে আর যুদ্ধ হচ্ছে না। তখন সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী তবিবুরদের প্রস্তুত হতে বললেন- এমন পরিস্থিতি তৈরি কর যেন প্রমাণ করা যায় এখনও যুদ্ধ চলছে। আমাদের তিন ভাগে ভাগ করে তিনটি টার্গেট দেওয়া হলো। আমাদের টিমে ছিলেন ৬ জন। আমাদের টার্গেট ছিল শহরের বিদ্যুৎ কার্যালয়ে আক্রমণ।

তবিবুর রহমান বলেন, টার্গেট অনুসারে সন্ধ্যার পর আমরা বিদ্যুৎ কার্যালয়ে আক্রমণ করি। এতে পুরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। উদ্দেশ্য- পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রেখে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করা, এ অঞ্চলে যুদ্ধ এখনও চলমান। 

এরপর তানোর থানা, সাকোয়া ক্যাম্পসহ কয়েকটি স্থানে গেরিলা আক্রমণ করে রাজশাহীতে আমাদের অবস্থান জানান দিতে থাকি। আর প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ফিরে আসায় আমাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। 

পরে আমি মেজর গিয়াসকে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ জানাই। তিনি আমাকে তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফরিদপুরে ইপিআর ক্যাম্পে পাঠান। এটার পাশে ইসলামপুরে তখন ছিল পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি। ওই ঘাঁটি আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাদের। অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাগে ভাগ হয়ে এগোই আমরা। আমাদের গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার হাসেম এবং অপর গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার ইসমাইল। ৩ নভেম্বর রাত যখন তিনটা বাজে শত্রুপক্ষের ওই ঘাঁটি লক্ষ্য করে মর্টার আক্রমণ শুরু হলো- বলতে থাকেন এই গেরিলা যোদ্ধা।

ওই লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের অবস্থান ও অস্ত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। যে কারণে আমরা ৯ সহযোদ্ধাকে হারাই। তারাই ছিল আমাদের সাব সেক্টর ৪-এর মূল শক্তি।

এর আগে আমাদের ওপর দায়িত্ব আসে গোদাগাড়ীর ডোমকুলীর অভয়া সেতু গুঁড়িয়ে দেওয়ার। এই সেতু দিয়ে হানাদার বাহিনী রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যাতায়াত করত। সেতুটি ভাঙতে পারলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হবে। আমরা নির্দেশনা মতো রাত ১২টার পরে দুই ভাগে ভাগ হয়ে নদী পথে ওই সেতুর উদ্দেশে রওনা হই। দুই নৌকায় ২০ থেকে ২৫ মুক্তিযোদ্ধা আছি। রাত আনুমানিক দুটার দিকে মহানন্দা দিয়ে অভয়া সেতুর কাছে আসি। আমার কাছে এসএলআর। মেজর গিয়াস সামনে সামনে, পাশেই সফিকুর রহমান রাজা ভাই। আমরা তাদের পিছে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের নৌকার মুখোমুখি হয়ে যাই। নৌকা থেকে গুলি ছুড়তেই আমরাও গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। আমাদের মেশিনগান থেকে একসঙ্গে আড়াইশ গুলি বের হয়। সেই অস্ত্রের গুলিতে পাক হানাদারদের নৌকার আলোগুলো নিভতে শুরু করে। এ সময় মেজর গিয়াস রাজা ভাইয়ের নেতৃত্বে চারজনকে ডোমকুলী গ্রামে পাঠান খবর নিতে যে পাকিস্তানি বাহিনী ডুবে গেছে নাকি চলে গেছে।

এ সময় আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। আমাদের সহযোদ্ধা তৌহিদ নৌকার হালের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছেন। ঠিক সে সময় শত্রুদের গুলি এসে তার বুকে লাগে। তিনি নৌকার ওপরে পড়ে যান। ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠছে। এ সময় আমাদের মাঝে রাজা ভাই ফিরে মেজর গিয়াসকে জানালেন, এখানে পাকিস্তানের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ আহত সেনা সদস্যকে ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে। কিছু লাশ তারা ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে। সেতুটি ধ্বংস করতে না পারলেও আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে পেরেছি। আমরা পরে বাসুদেবপুর স্কুলে উঠলাম। পরে শহীদ তৌহিদের লাশ নিয়ে ফরিদপুরে ফিরে সেখানে দাফন করলাম। 

চাঁপাইনবাগঞ্জে সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় ১৩ নভেম্বর। তখন ওই অঞ্চলের শত্রুসেনারা বিডি হলে অবস্থান করছে। নির্দেশনা এলো সেখানে গিয়ে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে। এই লক্ষ্যে আমরা রাজরামপুর দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করলাম। আমাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১২ নভেম্বর রাতে রাজরামপুর হাসিনা গার্লস স্কুলে আমরা আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। আমাদের সঙ্গে এলএমজি ও এমএমজি ছিল। গোদাগাড়ীর শেষে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শুরুর হরিপুরে একটি কালভার্ট ছিল। যা ওই অঞ্চলের যোগাযোগে প্রধান সড়ক। এটা ভাঙাই আমাদের দায়িত্ব ছিল। শুরু থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল।

১৩ নভেম্বর সেখানে যেতেই আমাদের তুমুল লড়াই শুরু হয়। পাশাপাশি শুরু হয়। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রভর্তি ট্রাক আসতে শুরু করে সেখানে। ওই যুদ্ধই ছিল আমাদের পরীক্ষার। কয়েকদিন ধরে চলে ওই যুদ্ধ। ১৪ ডিসেম্বর এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর শহীদ হন। বিপুল সমরাস্ত্রে সজ্জিত হানাদারদের বিপরীতে আমাদের প্রধান অস্ত্র ছিল দৃঢ় মনোবল ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। ১৫ ডিসেম্বর ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা