× ই-পেপার প্রচ্ছদ জাতীয় রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত ফিচার শিল্প-সংস্কৃতি ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মুক্তিযুদ্ধের ফেরিওয়ালা ক্যাপ্টেন বাবুল

সাজ্জাদ হোসেন রনি, ফরিদপুর

০৯ মার্চ ২০২৩ ০৯:৫০ এএম

নুর মোহাম্মদ বাবুল।

নুর মোহাম্মদ বাবুল। যিনি সারা জীবন সত্য-সুন্দরের পক্ষে অবিচল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ, বিপ্লবী। ৮৯ বছর বয়সি এ বিপ্লবী সময়ের প্রয়োজনে বারবার অস্ত্র তুলে নিয়েছেন।

ক্যাপ্টেন বাবুলখ্যাত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলকেই পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করেননি, ঘনিষ্ঠ সহচরদের একজন হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একাত্তরের অনেক আগে থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। হয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিও।

সশস্ত্র বিপ্লবের শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে একাধিক যুদ্ধের সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই সাব-সেক্টর কমান্ডার। দেশকে শত্রুমুক্ত করে ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর। বাংলা ও বাঙালির মাথা নত না করার ইতিহাস জানতে এই জাদুঘরে পরিদর্শন করেন দর্শনার্থীরা। শুধু তা-ই নয়, গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহেও উন্মুক্ত তার এই উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে নির্মোহভাবে তুলে ধরাই জনযুদ্ধের এই ফেরিওয়ালার জীবনের শেষ স্বপ্ন।

১৯৩৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নুর মোহাম্মদের জন্ম মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামে। তবে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফরিদপুরে। ১৯ বছর বয়সে তিনি বয়েজ নেভিতে যোগ দেন। চাকরিজীবনে লিডিং সি-ম্যান হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি জেলা জাসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নুর মোহাম্মদ। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। পরে তিনি কয়েকশ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফরিদপুর সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। শরীয়তপুরের ডামুড্যা, ভেদেরগঞ্জ, কাশিয়ানী ও গোপালগঞ্জে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নুর মোহাম্মদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিকামী মানুষের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সবুজসংকেত। সেই মোতাবেক ২৫ মার্চ আমি যাই ৩২ নম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্রই তিনি বলেন, ‘তাড়াতাড়ি যাও এবং স্থান পরিবর্তন কর। রাতেই পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় নেমে পড়ছে নির্বিচারে দেশের মানুষদের হত্যা করতে। তোমরা যার যার অবস্থান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়।’ তখন আমি ফকিরাপুল এলাকার একটি বাড়িতে থাকি। সেখান থেকে চলে যাই লৌহজংয়ে। কয়েকদিন পর এলাকার বেশ কিছু যুবককে নিয়ে থানায় গিয়ে ওসির কাছ থেকে দশটি রাইফেল এবং দুই হাজার গুলি জোর করেই নিয়ে আসি। সময়টা তখন এপ্রিল, সেই অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। 

সেখান থেকে চলে যাই ভারতে। সেখানে প্রথম দেখা করি মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। এরপর আগরতলা মেলাগরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিই। শেখ নাসের আমাকে নিয়ে যান সাজেদা চৌধুরীর কাছে। সাজেদা চৌধুরী সে সেময় ওখানে একটি ছোট বাসায় থাকেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাজারখানেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে চলে আসি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী ওড়াকান্দি স্কুলে। সেখানে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্প তৈরি করি। 

মুক্তিযুদ্ধের এই ফেরিওয়ালা বলেন, ৬ অক্টোবর আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে হামলা চালাই। প্রায় ৯ ঘণ্টা গুলিবিনিময়ের পর নিশ্চিত বিজয়ের মুখে শত্রুরা আকাশ থেকে বিমান আক্রমণ শুরু করে। সেই আক্রমণে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। ওই যুদ্ধে কামার গ্রামের জাফর আলী খান ও বরাকের চরের জাহাঙ্গীর খান শাহাদতবরণ করেন। সে সময় নগরকান্দার মেজর আজিজ আমাকে সাহচর্য দেন। 

নুর মোহাম্মদ বলেন, এরপর আমরা ১০ অক্টোবর ভেদেরগঞ্জের যুদ্ধে যাই। সেখানে শহীদ হন সহযোদ্ধা সর্দার মহিউদ্দিন। পরে মরদেহ নিয়ে তার বাড়িতে যাই। মরদেহ দেখে তার ছোট বাচ্চা বারবার বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে থাকে, ‘বাবা তোমার কী হয়েছে, তুমি চোখ মেলছ না কেন।’ ওই অবুঝ শিশুটিকে সেদিন আমি সান্ত্বনা দিতে পারিনি।

এরপর ১৪ অক্টোবর গোসাইরহাটের ডামুড্যায় শত্রুদের সঙ্গে ছয় ঘণ্টার তুমুল লড়াই হয়। দুই পক্ষই এলএমজি দিয়ে গুলি করছি ও গোলাবারুদ ছুড়ছি। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের মেজর, ক্যাপ্টেনসহ ৭৬ জন নিহত হয়। এ সময় আমাদের আটজন শহীদ হন। তাদের ভেদেরগঞ্জের শাহজাহানপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়।

আজন্ম লড়াকু নুর মোহাম্মদ বলেন, ২৮ নভেম্বর টুঙ্গিপাড়া গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য দোয়া প্রার্থনা করি। তাদের লুণ্ঠিত হয়ে যাওয়া কিছু জিনিস আমি উদ্ধার করতে সক্ষম হই। এরই মধ্যে আমি জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। 

২৯ নভেম্বর কোটালীপাড়ার ঘাগর বাজারে ও গোডাউন এলাকায় হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। তিন দিন যুদ্ধের পর ২ ডিসেম্বর শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। 

নুর মোহাম্মদ আরও বলেন, আমাদের কৌশর দেখে পাকিস্তানি মেজর সেলিম রাতে লঞ্চযোগে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু টেকেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা খলিল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে পরের দিন ভোরে গোপালগঞ্জ থানার ওসি অস্ত্রসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। 

নুর মোহাম্মদ বলেন, আমার রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা, দল পরিচালনা সর্বোপরি দলের প্রতি নিষ্ঠা ও সুশৃঙ্খলাবোধে উজ্জীবিত সহযোদ্ধা ও রণক্ষেত্রের যোদ্ধারা ১৪ ডিসেম্বর আমাকে ক্যাপ্টেন উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভাঙ্গা ডাকবাংলোয় উপস্থিত হয়ে ফরিদপুর আক্রমণের পরিকল্পনা করি।

তিনি বলেন, ২৬ মার্চ সকালে ফরিদপুর পুলিশ কন্ট্রোল ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পেয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ আওয়ামী লীগের নেতারা মাইকযোগে শহরজুড়ে প্রচার করেন। আমি ২৯ মার্চ লৌহজং থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম স্বাধীনতা, জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি।

যুদ্ধ শেষে নিজ বাসভবনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর গড়ে তুলেছেন এই বীর যোদ্ধা। এতে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র। রয়েছে ব্রিটিশ আলোকচিত্রী পল কনেটের তোলা মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র। সংগ্রহে রেখেছেন নিজের ও যুদ্ধকালের কিছু দুর্লভ ছবি।

শেয়ার করুন-

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা