স্বাধীনতার মাস
শফিউল আজম টুটুল, ঝালকাঠী
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৩ ১৭:২১ পিএম
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩ ১৭:২৮ পিএম
রমা রানী। প্রবা ফটো
বিয়ের আশীর্বাদ হয়ে গেছে রমা রানী দাসের। বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার। এরই মধ্যে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ঝালকাঠীর বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। আর যাওয়া হলো না শ্বশুরবাড়ি। হবু স্বামী পার্থ সারথী দাসের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঝালকাঠী শহর ছেড়ে রমা রানী যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
খালার সহযোগিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রমা রানী চলে যান ইছামতী নদীর ওপারে ভারতের টাকি ক্যাম্পে। সেখানে নারী সুইসাইডাল স্কোয়াডে যোগ দেন। ৯নং সেক্টরের অধীনে ৪৭ নারী নিয়ে গঠিত হয় এই স্কোয়াড। নেতৃত্বে রমা রানী। প্রশিক্ষণ দেন যশোর ক্যান্টনমেন্টের সুবেদার মেজর মাজেদুল হক। মাইন ও মর্টারসহ নানা প্রশিক্ষণ নেন নারী মুক্তিযোদ্ধারা। ইছামতী নদীর ধারে এই ক্যাম্পের সার্বিক খোঁজখবর নিতেন ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল। রমা রানী দাস তার নারী বাহিনী নিয়ে ছদ্মবেশে দেশে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিতেন ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসে অনেক ঝুঁকি গেছে তার ওপর। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার শঙ্কাও ছিল কয়েকবার।
ঝালকাঠী শহরের পশ্চিম চাঁদকাঠীর বাসায় প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বীর মুক্তিযোদ্ধা রমা বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। থাকতাম সে সময়কার সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার হলে। যেটি বর্তমানে কুয়েক মৈত্রী হল। ছাত্রলীগ করতাম। উত্তাল মার্চের গণ-আন্দোলন আলোড়িত করে আমাকে। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম। এই জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।’
রমা বলেন, যার সঙ্গে আশীর্বাদ হয়েছিল, সেই পার্থ সারথী দাসও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পার্থের সঙ্গে পারিবারিকভাবে আশীর্বাদের পরই শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। ঝালকাঠীতে তখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ অবস্থায় থেমে যায় বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা।
এই নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমার শ্বশুরবাড়ি ঝালকাঠী হলেও বাবার বাড়ি ছিল গৌরনদীর আগৈলঝাড়ায়। আমাদের পরিবার তখন ঝালকাঠীর প্রত্যন্ত জলাবাড়ী গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পার্থের সঙ্গে।’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রমা জানান, ভারতের টাকি ক্যাম্পে একদিন পরিদর্শনে আসেন মেজর জলিল। সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে পার্থ সারথী দাসকে দেখতে পেয়ে অবাক হন তিনি। বিস্মিত পার্থও। রমা জানতে পারেন, তার হবু স্বামীও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আছেন ৯ নম্বর সেক্টরের ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বে।
রমা বলেন, ‘যুদ্ধে মারা যাওয়ার আশঙ্কায় আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি পার্থ। তবে যুদ্ধ শেষে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভারতের কালিঘাটে মন্দিরে মন্ত্র পড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই আমরা।’
রমার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশেই বসা ছিলেন স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা পার্থ সারথী দাস। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিষয়টি ভাবতেই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। আমি যখন টাকি ক্যাম্পে গিয়ে দেখি, রমা ৪৭ নারী মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য হয়েছেন, তখন খুবই অবাক হই। এর আগে আমি জানতামই না রমা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তবে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোনো যোগাযোগ রাখিনি। যুদ্ধে আমি বেঁচে থাকব- এমন নিশ্চয়তা তো ছিল না। তাই আমি সব সময়ই তাকে এড়িয়ে গিয়েছি।’
রমার বাসার আলমারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া ক্রেস্টগুলো শোভা পাচ্ছে। সেগুলো একে একে বের করে দেখাচ্ছিলেন রমার ছেলে পিনাকি দাস। পিনাকি বলেন, বাবা-মা দুজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর চেয়ে সম্মান সন্তানের জন্য আর কী হতে পারে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এই দম্পতির এক ছেলে দুই মেয়ে। রমা রানী দাস ঝালকাঠী সরকারি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। স্বামী পার্থ সারথী দাস ঝালকাঠী সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।