মধ্যাঞ্চলীয় অফিস
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫১ পিএম
সিতারা বেগম।
১৯৭১ সালে যুদ্ধে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত হয় বাংলাদেশ হাসপাতাল। আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে নির্মিত ৪০০ শয্যার হাসপাতালটি ছিল সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে এ হাসপাতালে কমান্ডিং অফিসার (সিও) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন মহীয়সী নারী বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম।
সিতারা বেগম একাত্তরের জুলাইয়ের শেষ দিকে বাংলাদেশ হাসপাতালে সিও হিসেবে যোগদানের পর গোটা হাসপাতালে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে এসেছিল। মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও সেবা দিয়ে সবার মন জয় করেন তিনি। মুক্তিপাগল বাঙালিদের সাহস ও শক্তিও জোগান ক্যাপ্টেন সিতারা।
লন্ডন থেকে ডা. মবিন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন, ডা. আকতার, ডা. মুর্শেদ প্রমুখ এ হাসপাতালে কাজ করেছেন। হাসপাতালটিতে ৪-৫ জন মেডিকেলের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী কর্মরত ছিলেন। ১০-১২ জন স্বেচ্ছাসেবক সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলেন। সুবেদার পর্যায়ের উপরে কেউ ছিলেন না। কোনো ভারতীয় চিকিৎসক এ হাসপাতালে নিয়মিত থাকতেন না। রোগীদের ওষুধের জন্য আগরতলার উদয়পুরে যেতে হতো ডা. সিতারা বেগমকে। উদয়পুরের তৎকালীন ডিসি মি. ব্যানার্জি, আগরতলার এডুকেশন বোর্ডের পরিচালক ড. চ্যাটার্জি মজুমদার এবং ডা. চক্রবর্তী এ হাসপাতালের জন্য অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
এ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের ব্যবস্থাও ছিল। প্লাস্টিক দিয়ে থিয়েটারের মেঝে সম্পূর্ণ ঢাকা থাকত। হাসপাতালে যে শুধু বাঙালি রোগী বা আহত মুক্তিযোদ্ধারাই চিকিৎসার জন্য আসতেন তা নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল রব হেলিকপ্টারে গুলিবিদ্ধ হলে তিনি বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
বীরপ্রতীক সিতারা বেগমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার তালতলায়। মোহাম্মদ ইসরাইল ও হাকিমুন নেসার দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সিতারা তৃতীয়। বাবার আইন ব্যবসার সূত্র ধরে কিশোরগঞ্জের পৈত্রিক বাড়িতে তার শৈশব কেটেছে। ১৯৬১ সালে সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জ সরযূ বালা (এসভি) সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞানে প্রি-মেডিকেল ও ১৯৬৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে ইন্টার্নশিপ করে চিকিৎসক হন।
স্কুলজীবনে সিতারা বেগম গার্ল গাইডের দলনেতা ছিলেন। তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে তার সুখ্যাতি ছিল। শিক্ষাজীবনে তিনি ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়নসহ বহু খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
চিকিৎসক হওয়ার পর ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে তিনি সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। সত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় সিতারা বেগম কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন। ঠিক একই সময় তার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এটিএম হায়দার (বীরউত্তম) পাকিস্তানের চেরাট (পিন্ডি) থেকে বদলি হয়ে কুমিল্লায় তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে (এসএসজি) যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রমজানের ছুটিতে দুই ভাই-বোন কিশোরগঞ্জের বাসায় আসেন।
মেজর হায়দার ছুটি শেষ করে ফিরে গেলেন। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগমের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মেজর হায়দার ক্যান্টনমেন্ট থেকে লুকিয়ে ঢাকায় ফুফার বাসায় দেখা করে সিতারা বেগমকে সেনাবাহিনীতে যোগদান না করার জন্য বলেন। ভাইয়ের পরামর্শে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে কিশোরগঞ্জের বাসায় ফিরে যান। ১৬ এপ্রিল কিশোরগঞ্জের আকাশে দুটি পাকিস্তানি জঙ্গিবিমান চক্কর দিতে থাকে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে আশঙ্কা করে সিতারা বেগম চলে গেলেন মামার শ্বশুরবাড়িতে। কয়েক দিন পর আবার ফিরে এলেন কিশোরগঞ্জে।
এর মধ্যে কুমিল্লা সিএমএইচ থেকে দুই-তিনটি টেলিগ্রাম আসেÑ চাকরিতে যোগদান করার জন্য। বাবা উত্তর পাঠালেন- সিতারা বেগম অসুস্থ। কিশোরগঞ্জ শহরে অবস্থানের মধ্যেই পাকিস্তানি মিলিটারি আসার আগে আগে তিনি শহরের ১০-১২ মাইল উত্তরে হোসেনপুরে মায়ের নানাবাড়ি চলে যান। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের তত্ত্বাবধানে শহরে প্রচারপত্র (লিফলেট) ছাড়া হলো- এই পরিবারকে ধরিয়ে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। ওই সময় তাদের পুরো পরিবার আত্মগোপনে ছিল।
জুলাই মাসের শেষের দিকে বড় ভাই হায়দার পরিবারের কাছে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে পাঠান। তাদের সঙ্গে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে করিমগঞ্জের গুজাদিয়া ঘাট থেকে সিলেটের টেকেরঘাট হয়ে নৌকায় ৮-১০ দিন পর মেঘালয় পৌঁছান। সেখান থেকে ট্রাকে করে চলে যান শিলং। শিলংয়ে ৪-৫ দিন থাকার পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অসুস্থ মা-বাবাকে নিয়ে অবশেষে গোহাটি দিয়ে মেলাঘরে পৌঁছেন। সেখান থেকেই ভাইয়ের পরামর্শে ও দেশের জন্য লড়াই করা বীর যোদ্ধাদের সেবার ব্রত নিয়ে ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেন।
১৬ ডিসেম্বর রাতে বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে রেডিওর মাধ্যমে সিতারা বেগম ও তার সহকর্মীরা ঢাকা মুক্ত হওয়ার সংবাদ পান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় বদলি হন। এক সপ্তাহ পর ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে মহীয়সী এই নারীর আবদানের জন্য তাকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে (এলএ) ঢাকায় এলে কোথায় সেই সাহসী নারী- বলে সবার উপস্থিতিতে সিতারা বেগমের প্রশংসা করেন। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭২ সালের অক্টোবরে ক্যাপ্টেন আবেদুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী ১৯৭৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে গেলে সিতারা বেগমকেও সঙ্গে যেতে হয়। যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা যুদ্ধ করলে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ?’
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থানে বড় ভাই এটিএম হায়দার নিহত হন। ভাইয়ের মৃত্যু তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি। যে গেরিলা কমান্ডারকে হানাদাররা স্পর্শ করতে পারেনি, স্বাধীন দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
সিতারা বেগমের ভাষায়, ‘যেহেতু আমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তাই হয়তো প্রাণে বেঁচে আছি। নয়তো অন্য সবার মতো আমাকেও কোনো না কোনো ষড়যন্ত্রের জালে ফেলে হত্যা করা হতো।’
প্রবাস জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বড় ভাইকে হত্যার পর দেশের প্রতি তীব্র অভিমান ছিল। দেশের পতাকা দেখলে আমার কান্না আসত।’
দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম বর্তমানে স্বামীসহ আমেরিকায় বসবাস করছেন। সুযোগ পেলেই তিনি কাউকে না জানিয়ে স্বাধীনতার মাস মার্চ কিংবা বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশে আসেন। দেশে এলেই তিনি বিনামূল্যে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবাসহ নানান মানবিক কাজ করেন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, সুযোগ পেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে আবারও দেশে আসবেন এবং সন্তানদের সময়মতো তিনি দেশে পাঠাবেন।
কিশোরগঞ্জের বাসায় থাকা সিতারা বেগমের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা এটিএম সাফদার জিতু বলেন, বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য নিদর্শন। অথচ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়নি। বিষয়টি দুঃখজনক।