ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ১৩:১১ পিএম
বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাস।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিল- রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। উনি এত বড়মাপের মানুষ হয়ে আমার দেশের জন্য মরতে পারবেন, তাহলে আমি কেন পারব না?’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে যান ঠাকুরগাঁওয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ চন্দ্র দাস। সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের হাড়িপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া রমেশ চন্দ্র মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশের স্বাধীনতার জন্য শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুধু দেশের প্রতি প্রবল টানে অস্ত্র হাতে তুলে নেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, জন্মের পর বাবা মারা যান। এক বড় ভাই ছিল, প্রতিবন্ধী। মা মানুষের বাসায় কাজ করে যা আয় করতেন তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতেন। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করার কিন্তু এত অভাবের মধ্যে কীভাবে পড়াশোনা করবেন? তাই পাশাপাশি রাখালের কাজ শুরু করেন। পরে মা মারা যান। একমাত্র প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে পড়েন বিপাকে।
কিন্তু দেশ তো স্বাধীন নয়। উর্দু ভাষায় কথা বলা, অন্য দেশের কথামতো চলা। না, মানি না এসব। সবাই দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছে। আমিও যাব যুদ্ধে, দেশকে স্বাধীন করব।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ঘটনা বর্ণনা করেন রমেশ চন্দ্র। তখন ঠাকুরগাঁওয়ে অনেক তাণ্ডব। তখন আমরা ভয়ে পালিয়ে চলে যাই এবং আশ্রয় নেই ভারতের পাটাগড়া ক্যাম্পে। ওখান থেকে আমরা শুনলাম মুক্তিযোদ্ধায় লোক নিচ্ছে। আমি এবং সঙ্গে থাকা কালিচরণ ও রতিকান্ত মিলে রাস্তার পাশে গল্প করছি- মুক্তিযোদ্ধায় নাকি লোক নিচ্ছে, কোথায় নিচ্ছে, কোথায় যাব? এমন সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমান। তিনি আমাদের দেখে বললেন, তোমার এখানে কী করছ, দেশের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না, দেশকে স্বাধীন করবে না? আমরা বলি, ভাই করব, কোথায় যাব? তখন তিনি আমাদের বললেন, কাল সকালে তোমাদের তিনজনকে থুকরাবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যাব।
প্রতিবন্ধী বড় ভাইকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আনসার কমান্ডার আব্দুর রহমানের সঙ্গে চলে যাই থুকরাবাড়ি ক্যাম্পে। সেখানে আমাকে জয়েন করিয়ে দেয়া হলো। সেখানে আমাদের ১৬ দিন ট্রেনিং করায়। ১৬ দিন পর আমি দীন মুহাম্মদ কমান্ডারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আবার পাটাগড়ায় চলে আসি। এখানে এসে আমরা ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে ধরা পড়লাম। তারা আমাদের পানিঘাটায় নিয়ে গেল, সেখানে তিন দিন ছিলাম। পরে আমাদের কম্বল দিল, তাদের খাতায় নাম লিখে নেওয়া হলো।
তিন দিন পর আমাকে আবার নিয়ে যায় মুজিব ক্যাম্পে। সেখানে আমাদের ট্রেনিং হলো ২৮ দিন। পরে থ্রি নট থ্রি, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, স্টেনগান, এলএমজি, মাইন এসএলআর ট্রেনিং দেওয়ার পর আমাদের নিয়ে আসা হলো মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরের বুড়িমারী হাটে। সেখানেই সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশারের অধীনে যুদ্ধ করি। আমাদের সঙ্গে সব সময় একটি বন্দুক, একটি বেলচা (মাটি খোঁড়ার যন্ত্র), থালা ও গ্লাস থাকত। আমরা যখন ঘুমাতে যেতাম, তখন একটি গর্ত করে তার মধ্যে দুই-তিনজন একসঙ্গে ঘুমাতাম। একজনের খাবার তিনজন মিলে ভাগ করে খাই। বুড়িমারীতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করি।
সেখানে জয়লাভ করার পর চলে গেলাম নীলফামারী। নীলফামারী রেলস্টেশনের পাশে কলেজ ছিল, জায়গাটার নাম লটখানা। সেখানে আমরা লড়াই করলাম। সেখানে আমরা জয়লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা উদযাপন করি। পরে রিলিজ হয়ে আমরা আবার পাটাগড়ায় গেলাম। পাটাগড়া থেকে জন্মস্থান আকচা ফিরে আসি।
রমেশ দাস জানান, যুদ্ধ থেকে ফিরে নতুন সংসার শুরু করেন। এখন তার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে বাস ও রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে। ছোট ছেলে ব্যবসা করে। তিনি বাজারে একটি দোকান নিয়ে বাইসাইকেল মেরামত করেন। ৩০ বছর অপেক্ষার পর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া শুরু করলে তিনিও সে ভাতা পান। প্রথম দিকে ৩০০ টাকা থেকে এখন ২০ হাজার টাকা মাসিক মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি পাকা ঘরও পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও ঘর না পেলে জীবন চালানো কষ্টকর হয়ে যেত।