মো. আবীর হাসান, পিরোজপুর
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৫ পিএম
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব্বানী ফিরোজ। প্রবা ফটো
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২৪ বছর। মানে টগবগে তরুণ। পিরোজপুর সদরের এই বাসিন্দা পড়াশোনা করতেন খুলনায়। সব বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে যাওয়ার। পিরোজপুরে ফিরেই স্বাধীনতাযুদ্ধের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হলেন।
মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অংশগ্রহণের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিকথা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব্বানী ফিরোজ। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর এমএ জলিল।
রব্বানী ফিরোজ জানান, সেক্টরটি তিনটি সাব-সেক্টরে বিভ্ক্ত ছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন তিনজন কমান্ডার। মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (সুন্দরবন), মেজর মেহেদী আলী ইমাম (পটুয়াখালী) ও শাহজাহান ওমর আলী (বরিশাল পিরোজপুর অঞ্চল)।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, আমরা কীভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব বা কীভাবে প্রশিক্ষণ নেব- এমনটা যখন ভাবছিলাম, ঠিক তখনই তৎকালীন মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ পিরোজপুরে এলেন। আমরা যারা যুদ্ধে যেতে চাইলাম, তারা তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলাম। তিনি আমাদের নিয়ে সরকারি স্কুল মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করলেন।
তৎকালীন অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, ডা. আবদুল হাই পিরোজপুরের স্থানীয় নেতাদের নিয়ে পিরোজপুর স্বাধীনতা মঞ্চে একটি সভার আহ্বান করেন। এনায়েত হোসেন খানের কাছে সেখানে উপস্থিত জনতার একটাই আবেদন ছিল- আমাদের অস্ত্র দিন, আমরাও যুদ্ধে যাব।
পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়েই সেদিন একখণ্ড স্বাধীন ভূখণ্ডের আশায় এক অচেনা-অজানা পথে পা বাড়িয়েছিলেন তরুণ রব্বানী ফিরোজ। ১৯৭১-এর ৪ মে যখন পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পিরোজপুরের মানুষকে নির্বিচারে মারতে মারতে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখনই তারা নিজেদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করেন। তাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। যার জন্য যেখানে নিরাপদ মনে হয়েছিল, তিনি সেখান থেকেই বেরিয়ে পড়লেন।
রব্বানী ফিরোজ চলে গেলেন পটুয়াখালীর দায়িত্বে থাকা মেজর মেহেদী আলী ইমামের নেতৃত্বে। বাছাই হলেন প্রশিক্ষণের জন্য। সঙ্গে ছিলেন তাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড জাহিদ শাহ আলমগীর। তাদের নেতৃত্বে পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন। তখন নবম সেক্টরের অধীনে মেজর মেহেদী আলী ইমাম ও জাহিদ শাহ আলমের নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। একপর্যায়ে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পটুয়াখালী একটি সাব-সেক্টরের চিফ সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে। যার প্রধান দপ্তর ছিল বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়ায়। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধে পরিচালনা করেন।
একটি লোমহর্ষক ঘটনা
রব্বানী ফিরোজ বলেন, স্থানীয় আমাদেরই এক সহযোদ্ধা হঠাৎ করে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে শুরু করল বিদ্রোহ। একপর্যায়ে সে আমাদের সাব-সেক্টর পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতায় উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই লোকের পরিবারের সদস্যরা তৎকালীন জামায়াতের নেতৃত্বে ছিল। পরে সে যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য তাকে ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় ক্যাম্পে।
পিরোজপুর মুক্ত করার স্মৃতি
নভেম্বর থেকে পূর্ণাঙ্গরূপে আক্রমণ করতে পারায় বিভিন্ন এলাকা আস্তে আস্তে দখলে আসতে শুরু করে বলে জানান রব্বানী ফিরোজ। তিনি বলেন, পটুয়াখালী-পিরোজপুর-বরিশাল এই তিনটি দিক থেকেই আক্রমণ চলতে থাকে। যার নেতৃত্ব দেন মেজর মেহেদী আল ইমাম, মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও মেজর শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম)।
যুদ্ধের একপর্যায়ে মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল হুলারহাট থেকে এবং তিনিসহ একটি দল পাড়েরহাট থেকে পিরোজপুরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিরোজপুর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসে যায়। অবশেষে তারা ৮ ডিসেম্বর পিরোজপুরকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন।
আশা ও পাওয়া
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিনিময়ের আশায় আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিইনি। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারা একটু ভালো অবস্থান প্রত্যাশা করতেই পারেন। স্বাধীনতার পর এদেশে তাদের তেমন কোনো জায়গা ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হলেও সম্মান-অবস্থান পেয়েছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রব্বানী ফিরোজ ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর সদরে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ও তিন মেয়ে রয়েছে তার। বর্তমানে বসবাস করেন শহরের বনানী আবাসিক এলাকায়।