বাগেরহাট প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩ ২২:১২ পিএম
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে কিছুতেই থামছে না মায়ের আহাজারি। প্রবা ফটো
বাধ মানছে না অশ্রু। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে কিছুতেই থামছে না মায়ের আহাজারি। ‘আমার পাখি উড়ে গেছে। দুনিয়ায় আমার আর কিছু থাকল না। কিসের আশায় বাঁচব, কাকে নিয়ে বাঁচব আমি।’
শনিবার (১৮ মার্চ) বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া এলাকায় বাবার ঘরের বারান্দার খাটে বসে এভাবে বিলাপ করছিলেন পিরোজপুর সদর উপজেলার শংকরপাশা এলাকায় বাসচাপায় নিহত মো. বাদশা শেখের মা জরিনা বেগম। সন্তানের শোকে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
নিহত বাদশা বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জস্থ মালোপাড়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত দবির উদ্দিনের ছেলে। কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ রশিকলাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেনিতে পড়ত। ১৮ মাস বয়সেই বাবাকে হারায়। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী ছাড়াই ছেলেকে আকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন অসহায় এই মা।
জরিনা বেগম আরও বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর কলিজার টুকরো বাদশাকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। অনেক কষ্ট করে বাদশাকে বড় করেছি। সে ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না। ওকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন ছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বিয়েও করিনি। বাদশা সব সময় বলত এসএসসি পাশ করলেই আমার আর কষ্ট হবে না। পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে চাকরি হয়ে যাবে। তখন শুধু শান্তি করবা। আমার বাবা একবারে পাশ করে গেছে…।’ বলতে বলতে আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জরিনা বেগম।
গত শুক্রবার বিকেলে নসিমন গাড়িতে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যাটারিংয়ের কাজে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় বাদশা শেখ। এই দুর্ঘটনায় নসিমনে থাকা ১৮ জনের মধ্যে বাদশাসহ ৫ জন নিহত হন।
নিহত বাকি ৪ জন হলো বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার পালপাড়া গ্রামের শাহিন মল্লিক, মাঠ রাড়িপাড়া এলাকার শাহিন মোল্লা, মোরেলগঞ্জ উপজেলার চোমড়া এলাকার সাব্বির শেখ, একই এলাকার ইয়াসিন মিনা।
সাব্বির গোয়ালমাঠ রশিক লাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেনিতে এবং ইয়াসিন মিনা যদুনাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ম শ্রেনিতে পড়ত। এছাড়া এই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সিরাজুল ইসলাম শিমুল, অনিক দত্ত ও বনি আমিন নামের তিন তরুণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। শনিবার বিকেলে নিজ নিজ বাড়িতে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নিহত শাহিন মল্লিকের মা পেয়ারা বেগম বলেন, ‘নৌবাহিনীতে আবেদন করেছিল আমার বাবা শাহিন। বাবার আর চাকরি করার স্বাদ মিটল না। কোন মায়ের সন্তান যেন নসিমনে না ওঠে…।’ এই বলে বিলাপ করছিলেন তিনি।
একমাত্র ভাইকে হারিয়ে কান্না থামছেনা নিহত শাহিন মোল্লার ছোট দুই বোনের। শাহিনের বোন সেজুতি আক্তার বলেন, ‘আমরা দুই বোন এক ভাই। শাহিন ভাই-ই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। শোনার পর থেকেই আব্বা ও মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কোন কথাও বলছেন না। কী হবে আমাদের এই বলে আবারও কান্না শুরু করেন ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থী সেজুতি আক্তার।’
এদিকে পাশাপাশি এলাকায় পাঁচ তরুণের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্থানীয়দের মাঝে। মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা পার হলেও নিহতদের পরিবারকে কোনো সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। নিহতদের পরিবারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ইকবাল মোল্লা বলেন, যারা মারা গেছে প্রত্যেকের পরিবার খুবই অসহায়। মাত্র একশ টাকার জন্য এরা ক্যাটারিং সেবা দিতে গিয়েছিল। এক কথায় একশ টাকা আয় করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তারা। এসব পরিবারকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়া দরকার।
কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাছমিনা খাতুন বলেন, নিহতের পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। স্বজনহারা এই পরিবারের জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থাকবে। আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব।