রেজাউল করিম, গাজীপুর
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩ ১২:৪৫ পিএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৩ ১২:৪৬ পিএম
সাত্তার মিয়া।
আজ ঐতিহাসিক ১৯ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ঢাকার উত্তরে জয়দেবপুরে (বর্তমান গাজীপুর) অকুতোভয় মুক্তিকামী বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
ঐতিহাসিক এই দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন প্রথম প্রতিরোধের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সাত্তার মিয়া। একাত্তরে জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের কৌশলে নিরস্ত্র করার জন্য তাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় ঢাকা ব্রিগেড সদর দপ্তর। কিন্তু মুক্তিকামী বাঙালি সৈন্য ও স্থানীয় জনতা তাদের মতলব বুঝতে পেরে অস্ত্র জমা না দিয়ে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করেন। ফলে ১৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের সতর্কতা ও রাস্তায় আন্দোলনকারীদের দেখে অস্ত্র জমা নেওয়ার আশা ত্যাগ করে ঢাকায় ফিরে যান। এ সময় ছাত্র-জনতা জয়দেবপুরের রেলক্রসিং এলাকা ও চান্দনা চৌরাস্তায় তাদের বাধা দেন। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুড়লে ছাত্র-জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। গুলিতে শহীদ হন হুরমত, নিয়ামত, কানু মিয়া ও মনু খলিফা। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম।
সেই দিনের বর্ণনা দিয়ে সাত্তার মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘১৯ মার্চ গাজীপুরের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাত ১১টায় রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম, এমন সময় খবর দেওয়া হলো ঢাকা থেকে সামছুর রহমান এবং জয়দেবপুর থেকে হাবিবুল্লাহ ও মোজাম্মেল হক এসেছেন। আমাকে চৌরাস্তা যেতে হবে। পরে বন্ধু আব্দুল বারীকে নিয়ে চৌরাস্তায় যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু বলেছেন জয়দেবপুরের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্র পাঞ্জাবিরা কেড়ে নিয়ে যাবে। আমাদের রাস্তা অবরোধ করে অস্ত্র কেড়ে নিতে হবে। এ তথ্য জানার পর প্রথমে জয়দেবপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হযরত আলী, পরে টঙ্গীর আব্দুল হাকিমসহ আরও কয়েকজনকে জানিয়ে বাসায় আসি।’
সাত্তার মিয়া আরও বলেন, ‘১৯ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ঢাকা থেকে ১৮টি ট্রাক ও লরিতে অস্ত্র নিয়ে আসে। চৌরাস্তায় এসে তারা ব্যারিকেড দেখতে পায়। পরে স্থানীয়দের সাহায্যে তা সরিয়ে ফেলে। এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তার দিকে তিন গ্রুপে রওনা হয়। এক গ্রুপ গাড়িতে এবং বাকি দুই গ্রুপ হেঁটে। এক গ্রুপ চান্দনা স্কুলমাঠে এবং এক গ্রুপ চান্দনা ঈদগা মাঠে অবস্থান নেয়। তখন আমি তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলাম- বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জয় বাংলা। আমার স্লোগান শুনে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব কাছে এসে বললেন, স্টপ স্লোগান, আদারওয়াইজ আই উইল ফায়ার। তখন আমি বললাম আই উইল স্টপ স্লোগান। তখন জাহানজেব বললেন, ১ থেকে ৩ পর্যন্ত গুনব স্লোগান না থামালে গুলি করে দেব। সে এক বললেন, আমি স্লোগান দিলাম, সে দুই বলল, আমি স্লোগান দিলাম, কিন্তু তিন বলার আগেই সে রাইফেল তাক করল। এ সময় এক সহযোগী রফিউদ্দিন আমাকে টান দিলেন। পরে দুজন দৌড় দিই। তখন জাহানজেব পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। ধরে ফেলবে, এমন সময় একজন পেছন থেকে বাঁশ দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেন। সে পড়ে গেলে আমি দ্রুত চলে যাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দৌড়াদৌড়ি করছি, এমন সময় গুলির শব্দে থমকে দাঁড়াই। পরে জানতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী যাকে পাচ্ছে তাকেই মারছে। আমার পাশের গ্রামের কৃতী ফুটবলার হুরমত আলীকে পাকিস্তানি বাহিনী মারছিল। তখন হুরমত রাইফেল কেড়ে নিতে চেষ্টা করেও পারছিল না। এমন সময় কড্ডা এলাকার কানু মিয়া লাঠি দিয়ে সেনাদের আঘাত করে। তখন হুরমত রাইফেল কেড়ে নেয়, কিন্তু তখনই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে মারা যায়। এ সময় কানু মিয়াও গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ৭ দিন পর তিনিও মারা যান। এ সময় অনেক মানুষ আহত এবং পঙ্গু হয়েছে।’
শহীদ কানু মিয়ার কবর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে গাজীপুর মহানগরীর কড্ডা এলাকায়। এই বিষয়ে আব্দুস সাত্তার বলেন, এটি সংস্কার করা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার বাবার নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীদের বাধা দিই। এতে জয়দেবপুরের দুজন ও চৌরাস্তার দুজন শহীদ হন। তাই ঐতিহাসিক ১৯ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করলে অন্তত শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।’