১৯৭১ সালের মার্চ, চারদিকে শুধু গোলাগুলির শব্দ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ। যাকে যেখানে পাচ্ছে, হত্যা করছে। বাংলা মায়ের দামাল সন্তানরা রুখে দাঁড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। দেশে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে সবকিছু। তবু কিছু জায়গা ছিল যেখানে তাদের তেমন বিচরণ ছিল না। সে রকম একটি জায়গা আলমডাঙ্গা। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্তর্গত উপজেলাটি সে সময় কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত ছিল।
আলমডাঙ্গার বাজিতপুর গ্রামে পাক বাহিনীর চলাচল না থাকায় একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল একদল মুক্তিযোদ্ধা। সেই দলে ছিলেন আলমডাঙ্গার গোবিন্দপুর গ্রামের দামাল ছেলে খন্দকার জামশেদ নুরী টগর। আলমডাঙ্গা মডেল প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা শেষে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন আলোকদিয়া হাইস্কুল থেকে। এরপর আইকম ও বিকম শেষ করেন চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে। আইন বিষয়ে খুলনা ল কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের অভাব-অনটনের সংসারে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা চাকরি করতেন আলমডাঙ্গা গার্লস স্কুলে। টগরের ইচ্ছে ছিল পড়ামোনা শেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করবেন। কিন্তু বাঙালি সন্তান হওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি হয়নি। মনে একটা কষ্ট ছিল দেশসেবা করতে পারলেন না। কিন্তু যার মনে এত দেশপ্রেম তাকে আটকায় কে!
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিদ্ধান্ত নেন দেশের জন্য যুদ্ধে যাবেন। স্বাধীন করবেন বাঙলা মাকে। তিনি নিজ গ্রামে সবাইকে সংগঠিত করে দল গঠন করলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর এপ্রিলের শুরুতে দলবেঁধে সবাই চলে গেলেন ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ঢাকুরিয়া গ্রামে নিয়েছিলেন ট্রেনিং। এক মাসের ট্রেনিং শেষে ফিরে এলেন বাড়িতে। কিছুদিন পর অংশগ্রহণ করলেন মুক্তিযুদ্ধে।
১৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছিল। এমন সময় গুপ্তচর এসে খবর দেয় পুরো গ্রাম মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রহাতে পাশের পাটক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনীর দলে ছিল মাত্র আটজন যোদ্ধা। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ছিল অনেক সৈন্য। তাই যুদ্ধে জয়ী হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে ওঠে। চলছিল সম্মুখযুদ্ধ। একটা সময় গুলি ফুরিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাশেই ছিল গভীর এক খাল। সিদ্ধান্ত হয় সবাই খাল পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন। তখন গ্রুপ কমান্ডার টগর কভার দিয়ে দলটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। বাঁচাতে পেরেছিলেন ঠিকই। কিন্তু নিজে ফিরে আসতে পারেননি। পাক বাহিনীর একটা গুলি তার কপালের মাঝখান ফুটো করে। দলের অন্য সদস্যরা ততক্ষণে সরে গেছেন। নিজের জীবন দিয়ে দলের বাকি সদস্যদের বাঁচিয়েছিলেন টগর। হানাদাররা তার লাশ বাজিতপুর থেকে মহিষের গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় আলমডাঙ্গা থানায়। পায়ে দড়ি বেঁধে পুরো এক দিন উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে থানার বারান্দায়।
পরদিন ভোর থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। গোলাগুলির কান ফাটানো শব্দে কেউ ঘুমাতে পারেনি। আব্বা সকালে বের হলেন স্কুলের উদ্দেশে। যুদ্ধের জন্য স্কুল বন্ধ ছিল। তবু দাপ্তরিক কাজে তাকে যেতে হয়েছিল। একজন এসে মাকে খবর দিল কাল রাতের যুদ্ধে ভাই মারা গেছে। খবরটা শুনেই মা জ্ঞান হারালেন। বাড়িতে নিঃশব্দ কান্নার রোল। গ্রামে তখন মিলিটারির ছড়াছড়ি। কান্নাকাটির শব্দে যদি ওরা বুঝে যায়, তাই সবাই নিশ্চুপ।
আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। ছোট হলেও বাড়ির ভয়াবহ অবস্থা আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম। মাকে কোনোভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, তবু আব্বা বাড়ি এলেন না। মা আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাত ৮টায় আব্বা বাড়ি ফিরলেন। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ছেলেটি আমাদের টগর না। আলমডাঙ্গা থানা আর গার্লস স্কুল মুখোমুখি। স্কুল থেকে থানার সবকিছু খুব ভালোভাবেই দেখা যায়। তাই মা আব্বার কথা বিশ্বাস করলেন। যুদ্ধ চলাকালে অনেকেই বলেছে ভাইকে নাকি তারা যুদ্ধ করতে দেখেছে। তাই আমরা সবাই প্রতীক্ষায় ছিলাম ভাই ফিরে আসবে। কিন্তু আব্বা জানতেন ভাই আর কখনও ফিরবে না। কারণ সেদিন থানার বারান্দায় উল্টো করে ঝোলানো যে লাশ দেখেছিলেন তা আমার ভাইয়ের।
স্বাধীনতার পর আব্বার মুখে শুনেছিলাম, পাকিস্তানি বাহিনী আব্বাকে স্কুল থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। ভাইয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ইয়ে আপ ক্যা লাড়কা হ্যায়?’ আব্বা অস্বীকার করে বলেছিলেন, এ আমার ছেলে নয়। আমাদের গ্রামের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবেই আব্বা এ কাজ করেছিলেন। নিজের সন্তানের ঝুলন্ত লাশ দেখেও কী করে ধীর-স্থির ও অবিচল থাকা যায়। তা আজও বুঝতে পারিনি।
আলমডাঙ্গা থানা কাউন্সিল প্রাঙ্গণে তার কবর। ট্রেনস্টেশনের পাশেই রয়েছে তার নামে স্মৃতিসৌধ। রেলস্টেশনসংলগ্ন রাস্তার নামও শহীদ টগরের নামে। আলমডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড ভাদুর মোড়ে আছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। যেখানে তিনি শহীদ হয়েছিলেন সেই বাজিতপুর গ্রামে ক্যানেলের ধারে রয়েছে ‘শহীদ খন্দকার জামশেদ নুরী টগর’ স্মরণে সৃতিফলক। গোবিন্দপুর গ্রামে তার নামে রয়েছে একটি প্রাইমারি স্কুল। আলমডাঙ্গা লাল ব্রিজের কাছে সদ্য তৈরি করা হয়েছে বধ্যভূমি নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। শহীদ টগরের লাশ জানোয়াররা যেভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিল তার একটি নিদর্শন আছে এই জাদুঘরে।
লেখক : শহীদ মুক্তিযোদ্ধা টগরের বোন
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.