× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যুদ্ধাপরাধী পরিবারের দখলে লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি

মৌলভীবাজার প্রতিবেদক

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৪৫ এএম

আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৪৮ এএম

বিপ্লবী লীলা নাগের স্মৃতিবিজড়িত নিজ বাড়ির বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রবা ফটো

বিপ্লবী লীলা নাগের স্মৃতিবিজড়িত নিজ বাড়ির বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানাটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রবা ফটো

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা ‘মাসিক জয়শ্রী’র প্রথম নারী সম্পাদক, উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি নারী সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম ছাত্রী, নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বিপ্লবী লীলা নাগ। তার পৈতৃক বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ৪ নং পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে। এখানেই কেটেছে তার শৈশবের অনেকটা সময়। এখন এই বাড়িটি দখল করে আছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবার। 

সম্প্রতি বাড়িটিতে গিয়ে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলাউদ্দিনের পরিবার প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের বাড়িটি দখলে রেখে বিপ্লবী লীলা নাগের শৈশবের সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলেছে। লীলা নাগের পরিবারের বানানো সমস্ত ঘর ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। লীলা নাগের মা কুঞ্জলতা নাগের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাব-পোস্ট অফিসের প্রাচীন ভবনগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। লীলা নাগের শৈশবের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তার পৈতৃক বাড়ির সামনের বৈঠকখানাটিও সম্প্রতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। বাড়িতে থাকা প্রাচীন এবং দৃষ্টিনন্দন ঘরগুলো এখন আর নেই। নেই কোনো স্থাপনা, কোনো চিহ্ন। 

বাড়িটি যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের হাত থেকে উদ্ধার করে লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করে এখানে একটি জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছে লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদ, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও এলাকাবাসী। এ ব্যাপারে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

বিপ্লবী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়িটিতে বর্তমানে বসবাস করছেন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মো. আলাউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী ও পুত্ররা। বাড়িটিতে গিয়ে কথা হয় আলাউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী শামসুন্নাহার চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ৭০ বছর ধরে তারা এ বাড়িতে রয়েছেন। বাড়িটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান রয়েছে। 

সরকারি নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট ৫ দশমিক ৯৭ একর ভূমির ওপর বাড়িটি। বাড়িতে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। পাশেই রয়েছে ১৯৩৮ সালে লীলা নাগের মা কুঞ্জলতা নাগ প্রতিষ্ঠিত ‘কুঞ্জলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকরা লীলা নাগকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর তিনি সপরিবারে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে কয়েক বছর লীলা নাগের পৈতৃক বাড়িটি ৪ নং পাঁচগাঁও ইউনিয়ন অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

১৯৬৫ সালে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ থেকে এদেশে এসে আলাউদ্দিন চৌধুরীর পিতা হাজী ফাতির আলী চৌধুরী তৎকালীন মৌলভীবাজারের মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে লীলা নাগের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি একসনা বন্দোবস্ত নেন এবং বাড়িটি দখল করে নেন। পরবর্তী সময়ে মহকুমা প্রশাসকের কাছে আলাউদ্দিন চৌধুরী ও আকমল আলী তাদের অনুকূলে ৯৯ বছরের বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য আবেদন করেন। আবেদন নং-৫০/১৯৬৭। এরপর আলাউদ্দিন চৌধুরী আকমল আলীর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সরকার মোট ১২টি এসএ দাগে ৪ দশমিক ৩৯ একর ভূমি আলাউদ্দিন চৌধুরীর নামে লিজ দেন।

কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে আলাউদ্দিন চৌধুরী লিজমানি পরিশোধ না করায় তার ইজারা বাতিল করে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানার পর ১৯৮৮ সালে আলাউদ্দিন চৌধুরী আদালতে একটি স্বত্ব মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৪৫/১৯৮৮। ১৯৯০ সালে আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। ওই বছরই আলাউদ্দিন চৌধুরী উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল নং-১০৮/১৯৯০। সেটিও খারিজ হওয়ার পর ২০০০ সালে আলাউদ্দিন হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রিভিশন মামলা দায়ের করেন। যার নং-২৭২৫/২০০০। পরবর্তী সময়ে সরকার এই মামলা কী অবস্থায় আছে তা জানতে চাইলে ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি আলাউদ্দিন চৌধুরী একটি তথ্যপত্র দেখান।

তথ্যপত্রে দেখা যায়, মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগে অপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের ৮৯০নং স্মারকে সরকারি কৌঁসুলির (জিপি) কাছে মামলার অগ্রগতির বিষয়ে বিশদ জানতে চাওয়া হয়। সে সময়ে এর তথ্যভিত্তিক কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। সর্বশেষ ভূমি জরিপ রেকর্ডে পাঁচগাঁও মৌজার ৩২১, ৩৫৯, ৪১৭, ৪৯৫, ৮০৩, ৮৩৭, ৮৮০, ৯৪৫, ২২৮, ৪০৮, ৫৫৬, ৮১৩, ৮৪৪, ৮৬৮, ১০৭২, ১১১৯, ১২৩৪, ১২৮৮ ও ১৩১৫ খতিয়ানে লীলা নাগের পৈতৃক সম্পত্তি জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার-এর নামে নামজারি হলেও দখলে নিতে পারেনি জেলা প্রশাসন। এখনও ওই সম্পত্তি রয়েছে যুদ্ধাপরাধী আলাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের দখলে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজনগর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার ও উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক সজল চক্রবর্তী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিপ্লবী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়িটি উদ্ধারে যখন এলাকাবাসী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তখন রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। সে মামলায় তিনি হেরে গেলে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

বিপ্লবী লীলা নাগের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বাড়িটির দখলদার মো. আলাউদ্দিন চৌধুরী ১৯৭১ সালে পাঁচগাঁওয়ে অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাটে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাঁচগাঁও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত চার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আলাউদ্দিন চৌধুরীরও এই অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছিল। কিন্তু এর আগেই ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি মারা গেলে অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। 

লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদের সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ দেব প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিপ্লবী লীলা নাগের বাড়ি উদ্ধার ও হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরায় মেরামতের জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই বাড়িটি দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার ও সংরক্ষণ করা গেলে বাড়িটি পুরো উপজেলায় শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সূতিকাগার হয়ে উঠবে। বিপ্লবী লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারে আমরা রাজনগর উপজেলাবাসী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। 

এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান মুঠোফোনে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারের লক্ষ্যে রাজনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। হাইকোর্টে একটি মামলা থাকায় উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সমস্যা রয়েছে। প্রক্রিয়া চলমান। আমরা মামলাটি ‘ভেকেন্ট’ করার জন্য কাজ করছি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর নেতৃত্বে আমরা যথাযথ উত্তর দিয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত বাড়িটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা