ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩ ১০:০৭ এএম
আপডেট : ২৬ মে ২০২৩ ১০:৪১ এএম
ঠাকুরগাঁও সদরের চিলারং ইউনিয়নের রাস্তার দুইপাশে নিজের রোপণ করা সারি তালগাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত খোরশেদ আলী। প্রবা ফটো
ঠাকুরগাঁও সদর চিলারং ইউনিয়নের রাস্তার দুই পাশে সারি সারি তালগাছ। গাছগুলো রোপণ করেছেন খোরশেদ আলী নামের এক পল্লীচিকিৎসক। ইউনিয়নের আটটি রাস্তার পাশে এ পর্যন্ত ৫২ হাজার তালগাছ রোপণ করেছেন তিনি।
গাছগুলো পরিচর্যাও করেন ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় তিনি এ তালগাছ রোপণ করেছেন বলে জানান। পুরো ইউনিয়নে এক লাখ তালগাছ রোপণ করতে চান খোরশেদ আলী।
চিলারং ইউনিয়নের পাহাড়ভাঙ্গা গ্রামের খোরশেদ আলী বলেন, আমি একজন কৃষক ও পল্লীচিকিৎসক। পরিবারে সাত ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ১২ জন সদস্য। আয়ের উৎস বলতে নিজের অল্প কিছু কৃষিজমি এবং পল্লীচিকিৎসা, আর তা দিয়েই চলে সংসার।
রাস্তার পাশে এত তালগাছ কেন রোপণ করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে খোরশেদ আলী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের আত্মত্যাগের জন্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই সব বীর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছি। একই সঙ্গে মানুষ যাতে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পায়, তাই ইউনিয়নের আটটি রাস্তার দুই পাশ ধরে তালগাছের চারা রোপণ করেছি।
খোরশেদ আলী জানান, এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫২ হাজার তালগাছের চারা রোপণ করেছেন। তবে তার ইচ্ছা এক লাখ গাছ রোপণ করার। প্রতিদিন ব্যক্তিগত কাজ সেরে যতটুকু সময় পান, গাছগুলোর পরিচর্যা করেন। চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাকে বিভিন্ন গ্রামে যেতে হয়, যেখানে তালগাছ দেখেন, সেখান থেকে বীজ নিয়ে এসে রাস্তার পাশে রোপণ করেন। তবে গাছগুলো কিছু দুষ্টপ্রকৃতির লোক উপড়ে ফেলছে। তাই গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি সহায়তা কামনা করেন তিনি।
চিলারং ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল গফুর বলেন, অনেকদিন ধরে খোরশেদ আলী রাস্তার পাশে তালের বীজ রোপণ করছেন। তিনি সে গাছগুলো নিয়মিত দেখাশোনা করেন। এলাকার মানুষ এখন তাকে গাছপ্রেমিক হিসেবে চেনে।
গোলাপ হোসেন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এই যে রাস্তার দুই পাশে তালগাছগুলো দেখা যাচ্ছে, এগুলো ৮০ বছরের পল্লীচিকিৎসক খোরশেদ আলী রোপণ করেছেন। এটা তো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যদের রোপণ করার কথা। কারণ তারা সরকার থেকে বাজেট পান। আর খোরশেদ আলী নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মানুষের উপকারের জন্য এই গাছগুলো লাগিয়ে নিজেই পরিচর্যা করেন। তিনি সাধারণত রাতের বেলায় চারা রোপণ করেন। কারণ দিনে রোপণ করলে কেউ চারাগুলো নিয়ে যেতে পারে বা এই আঁটি (তালশাঁস) খেয়ে ফেলতে পারে। সাধারণত রাত ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে এই চারা রোপণ করেন তিনি। তাকে ইউনিয়নের সব মানুষ সম্মান করে। তাকে গাছপাগল ডাক্তার হিসেবে সবাই চেনে।’
খোরশেদ আলীর স্ত্রী সাজেদা বেগম বলেন, ১২-১৩ বছর ধরে তার স্বামী ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তায় তালের বীজ ও চারা রোপণ করছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা ও ইউনিয়নের মানুষ যাতে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পায়, তাই এ চারাগুলো রাতে রোপণ করেন তিনি। এজন্য অন্য মানুষকেও দিনমজুর হিসেবে নিয়েছেন তিনি। ১০ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। ঘরে বাজার না থাকলে সেই বাজার না আনলেও তালের বীজ কেনা তিনি ভোলেন না। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো। গাছ লাগানো তার নেশায় পরিণত হয়েছে।
সাজেদা বেগম আরও বলেন, মানুষ খোরশেদ আলীকে গাছপ্রেমিক হিসেবে চেনে। এখন বিষয়টি ভালো লাগে এবং তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। এ পর্যন্ত ৫২ হাজার গাছ রোপণ করেছেন। আরও ৪৮ হাজার গাছ রোপণ করবেন। সরকার কোনোভাবে সাহায্য করলে মরার আগে তার এক লাখ গাছ রোপণের স্বপ্ন পূরণ হবে।
খোরশেদ আলীর বড় ছেলে জাহিদ বলেন, ‘আমার বাবা একজন সহজ-সরল মানুষ। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি ২০১২ সাল থেকে তালের বীজ ও চারা রোপণ শুরু করেন। তাকে অনেক বাধা দিয়েছি, কিন্তু থামেননি। কোনোদিন তো রাত ৩টায় গাছ রোপণ করতে গেছেন। ১২ বছর ধরে তিনি ১ ঘণ্টা করে তার লাগানো রাস্তার গাছগুলো পরিচর্যা করেন।’
চিলারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি খোরশেদ আলীর অগাধ শ্রদ্ধা। তাদের স্মরণে এই ইউনিয়নের বিভিন্ন রাস্তায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫২ হাজার তালগাছের চারা রোপণ করেছেন তিনি। তার ইচ্ছা, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন এক লাখ তালগাছ লাগিয়ে যেতে পারেন। খোরশেদ আলী নিজ উদ্যোগে তালগাছের বীজ রোপণ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইউপি কার্যালয় থেকে তালগাছ রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, খোরশেদ আলীর তালগাছ লাগানো সমাজের ভালো কাজের একটি। জেলা প্রশাসনও তালগাছের বীজ রোপণ করে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তা করেছেন। এটা একটি মহৎ কাজ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সাধুবাদ জানাই। যে মহৎ কাজ তিনি করে যাচ্ছেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এটার উপকার পাবে। জেলা প্রশাসন খোরশেদ আলীর তালগাছ লাগানোকে উৎসাহিত করতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।