নাঈম ইসলাম, শেরপুর
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১১:২১ এএম
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১২:১৪ পিএম
বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল, দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর। প্রবা ফটো
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ১৩ জেলার মানুষের যোগাযোগের পথ সুগম করতে গাইবান্ধার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হয় গত বছরের ৯ এপ্রিল। এদিন লঞ্চ সার্ভিসের উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ প্রকল্প ছাড়াও বাহাদুরাবাদ-বালাসীঘাটে লঞ্চ সার্ভিস চালু করতে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ফুটানীবাজারে নির্মাণ করা হয় নৌ-টার্মিনাল। একই সঙ্গে যমুনা নদী খননে নেওয়া হয় পৃথক প্রকল্প। কিন্তু এর সবটাই ভেস্তে গেছে। উদ্বোধনের পরদিনই বন্ধ হয়ে যায় পৌনে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া এই প্রকল্প।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটি) তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে ২০১৪ সালে বাহাদুরাবাদ-বালাসীঘাটে নৌরুট ও ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে একনেকে বাহাদুরাবাদ-বালাসী নৌপথ আবারও চালু করতে ফেরিঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে কয়েক দফায় ব্যয় বাড়িয়ে প্রায় পৌনে ২০০ কোটি টাকা করা হয়। প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ, পার্কিং ইয়ার্ড, ফেরিঘাট, ইন্টারনাল রোড ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ড্রেজিং করা হয় ফেরিরুট।
প্রকল্প শেষে হঠাৎ করে নাব্য সংকট দেখিয়ে ২৬ কিলোমিটার নৌরুটটি চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করে বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি। ভেস্তে যায় সব পরিকল্পনা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে বালাসীঘাট নৌরুটটির দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে এই নৌরুট পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। শুষ্ক মৌসুমে পলিতে ফেরি আটকে যায়। লঞ্চ মালিকরাও এ রুট ব্যবহারে আগ্রহী নন। এ ছাড়া স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পের স্থান নিরূপণ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে এবং নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। এজন্য পুরো টাকাটাই গচ্চা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ (ফুটানীবাজার) ও গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাটের দুই পাড়ে নির্মিত করা হয় নৌ-টার্মিনাল ও নয়নাভিরাম অবকাঠামো। এ প্রকল্পের আওতায় বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, খাবার হোটেল, আনসার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
চুকাইবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান সেলিম খান বলেন, ‘একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করার নিয়ম রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্প হাতে নিয়ে নিজেদের পছন্দমতো দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে এ মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। খননকৃত নৌপথ উদ্বোধনের আগেই যান চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে নৌ-টার্মিনালটি। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছে যাত্রীরা; সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।’
এ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করা ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে দিনাজপুর থেকে রংপুর হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করত। রংপুর বিভাগের আট জেলা ও আশপাশের জেলার ট্রেনযাত্রীরা বালাসীঘাট থেকে রেলওয়ের ফেরিতে জামালপুরের বাহাদুরাবাদে পৌঁছে ময়মনসিংহ ও ঢাকায় যাতায়াত করতেন। এতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগত। আর সেতু হয়ে বাসে গেলে সময় লাগ ১০-১২ ঘণ্টা। ২০০৪ সালে বালাসীঘাট-বাহাদুরাবাদ ঘাট পরিত্যক্ত ঘোষণার পাশাপাশি রেলওয়ের ফেরি চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাদের ভোগান্তি বেড়ে যায়। পরে ঘাট নতুন করে সাজানো হলে ফের যাতায়াত শুরু করি। ঘাটে সরকার এত টাকা খরচ করার পরও এখন ফেরি বন্ধ। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে আর যাত্রীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে নদীপথে ফেরি সার্ভিস চালু হলে এ এলাকায় বেকারত্ব থাকত না। ঘাটকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ হতো।’
দেওয়ানগঞ্জের মন্ডল বাজারের ব্যবসায়ী রুহুল আমীন জানান, ‘সরকার পৌনে দুইশ কোটি টাকা খরচ করে ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুও হলো না। সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা গেল।’ যারা ঠিকমতো কাজ করেনি, তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
জামালপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কাজ শুরু এবং প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্তে এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এই নৌপথ চালু হলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কয়েক জেলার যোগাযোগে সময় ও খরচ অনেক কম লাগত। চাপ কমত যমুনা সেতুর ওপর। সরকারের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট করা হয়েছে। অপরিকল্পিত প্রকল্পে লুটপাটে জড়িতদের বিচার দাবি করছি।’
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সমীর পাল বলেন, ‘বাহাদুরাবাদ ও বালাসীঘাট যমুনা নদীর আড়াআড়ি অবস্থানে থাকায় সহজেই উজানের ঢলে বালু পড়ে চ্যানেল ভরাট হয়ে যায়। যে কারণে খননকৃত চ্যানেলে ফেরি বা বড় কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না।’
অপরিকল্পিত নদী খননের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নিজাম উদ্দিন পাঠান বলেন, ‘যমুনা নদীর চরিত্র বোঝা মুশকিল। বর্ষাকালে পানির সঙ্গে ভেসে আসে বালু। সেই বালুতে চ্যানেল ভরাট হয়ে যায়। তাই প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে দুই থেকে তিন মাস নদী খনন করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। আমরাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। যেভাবেই হোক নৌরুটটি চালুর চেষ্টা করা হবে।’
জামালপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বাহাদুরাবাদ-বালাসী ফেরিঘাটটি চালু করার জন্য যা কিছু করা দরকার তা করা হবে।’