সুনামগঞ্জ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৫৭ পিএম
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০৭ পিএম
টাঙ্গুয়ার হাওরে করচা গাছে উঠে লাফ দিচ্ছে পর্যটকরা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছ। প্রবা ফটো
টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি। ১৯৯৯ সালে সরকার এই এলাকাকে ‘বিপন্ন প্রতিবেশ এলাকা’ ও ২০০০ সালে ইউনেস্কো রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। এই হাওর বিরল প্রজাতির মাছ ও অতিথি পাখির স্বগরার্জ্য হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীব্যাপী অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন ২৬ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থলও হাওরটি। অথচ ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অবাধ বিচরণ ও যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা, গাছপালা নষ্ট করা- এসব কারণে সেখানকার জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে।
স্থানীয়দের দাবি, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। নাহলে অচিরেই এর সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। জেলা প্রশাসন বলছে, টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।
কয়েক বছর ধরে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের বিকাশ চোখে পড়ার মতো। প্রতি বছর বর্ষায় দেশ-বিদেশের হাজারও পর্যটক এই এলাকায় ঘুরতে আসেন। হাওরে ঘুরার সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। স্থানীয় নৌকার সঙ্গে প্রায় দুইশ আধুনিক হাউসবোট যোগ হয়েছে হাওরে। এই পর্যটন বিকাশ ইতিবাচক হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
সরকার প্রতি বছর কৃষকদের ফসল রক্ষার জন্য হাওরে শতকোটি টাকার অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে। বর্ষায় এই বাঁধ কোথাও সামান্য পানির নিচে আবার কোথায় জেগে থাকে। স্থানীয় নৌকা ও হাউসবোট হাওরে প্রবেশ ও ঘুরার নির্দিষ্ট রোড ব্যবহার না করায় এসব বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে।
এদিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনকে আরও প্রসারিত করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকবাহী নৌযান, হাউসবোট ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত না করা, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া হাওরে প্রবেশ না করা, ট্যাকেরঘাট এলাকা ছাড়া অন্য এলাকায় নৌকা, জলযানে রাত্রিযাপন করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহতি করা, জলযানে রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বহন না করা, সংরক্ষিত এলাকায় বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ, স্বাভাবিক আচরণ, প্রজনন, বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো হাতিয়ার, ফাঁদ, বিষ, মাছ শিকারের সরঞ্জাম বহন না করা, নৌযান, হাউসবোটের বর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে নির্দিষ্ট সেপটিক ট্যাংকে রাখা, স্বাভাবিক মাত্রার অধিক শব্দ সৃষ্টিকারী, কালো ধোঁয়া উদগীরণকারী বা ত্রুটিপূর্ণ কোনো জলযান পর্যটক পরিবহনে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, নৌযানে সৌরশক্তি ব্যবহার, উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী জেনারেটর বহন থেকে বিরত থাকা, হাওরের নির্জনতা বজায় রাখতে মাইক, মাইক্রোফোন জাতীয় উচ্চ শব্দযন্ত্র বহন করা যাবে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, পর্যটকবাহী নৌকাগুলো বৌলাই নদী হয়ে মাটিয়ান হাওরের বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করছে। পরে এই হাওর পার হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ করছে নৌকাগুলো। টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার এলাকায় গিয়ে নৌকাগুলো করচ গাছে বেঁধে রাখা হয়। ফলে এই এলাকায় থাকা শতাধিক হিজল করচ গাছের ডালপালাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওয়াচ টাওয়ারে নৌকা বাঁধার ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থাপনাটি। এ ছাড়া পর্যটকরা গোসল করেন এখানে। গাছে উঠে নিচে লাফিয়ে পড়া ও ডালপালাও ভাঙতে দেখা গেছে তাদের। হাউসবোটে প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন জাতীয় প্যাকেট ফেলার জন্য ঝুড়ি থাকলেও পানিতে প্লাস্টিকের থালা, পলিথিন ব্যাগ, ওয়ানটাইম গ্লাস ভেসে থাকা ও নৌকাতে উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় দর্শনার্থী আবুল হাসনাত কাজল বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। প্রতি বছর এখানে হাজারও পর্যটক আসে। তবে তাদের নিয়ে তাহিরপুর থেকে যখন নৌকাগুলো আসে তখন নির্দিষ্ট কোনো রোড ধরে আসা হয় না। ফলে হাওরের জীববৈচিত্র্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি শতকোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে। নদী দিয়ে যদি হাওরে আসা হতো তাহলে এই ক্ষতি হতো না।
দর্শনার্থী লুৎফর রহমান বাবর বলেন, পর্যটকরা ব্যবহারের পর বিভিন্ন বর্জ্য, প্লেট, প্লাস্টিক পানিতেই ফেলে দেন। ফলে হাওরের ক্ষতি হচ্ছে। নৌকাগুলো এসে হিজল করচ গাছে বাঁধার কারণে ভেঙে যাচ্ছে ডালপালা। সবকিছু মিলিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট হিসেবে ঘোষিত এলাকা। এটি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাও। এটিকে রক্ষার জন্য আমরা খুবই সচেতন। এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা তৈরি করেছি। এটি বাস্তবায়িত হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে পরিকল্পিত পর্যটন করা সম্ভব হবে।