ভাঙ্গা-কুয়াকাটা মহাসড়ক
রাশেদুল হাসান, ঢাকা ও মঈনুল ইসলাম সবুজ, বরিশাল
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ১০:৩৯ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১৫ পিএম
কুয়াকাটা সড়কের ফাইল ছবি
পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরুর পর ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে যানবাহনের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে সড়কটি রয়ে গেছে আগের মতোই সরু। মাত্র ২৪ ফুট প্রস্থের এই সড়কে নেই কোনো বিভাজক। ছোট ছোট গাড়ি চললেও সেগুলোর জন্য নেই আলাদা সার্ভিস লেন। সড়কের দুপাশে যানবাহন পড়ে যাওয়া থেকে প্রতিরোধে নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুতগতিতে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু ও ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে দূরপাল্লার পরিবহন যখন এ সরু মহাসড়কে প্রবেশ করছে, তখনই ছোট যানবাহনকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কিংবা বড় যানবাহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে।
ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২০৫ কিলোমিটার। এই মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়া কিংবা সড়কের ছোট গাড়িকে চাপা দেওয়ার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। গত ৫ আগস্ট রাতে মহাসড়কের গৌরনদী এলাকার খাঞ্জাপুরে বালুর ট্রাকের সঙ্গে ইউনিক পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে একজন নিহত এবং কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। এর আগে ২ আগস্ট এ মহাড়কের আশোকাঠি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এনা পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। এ সময় বাসচাপায় একজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত ও ৯ জন আহত হন।
গত ২৫ জুলাই এ মহাসড়কের গৌরনদী অংশে কাভার্ড ভ্যান ও যাত্রীবাহী বাস অন্তরা পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে বরিশাল বিভাগে ২৫ দুর্ঘটনায় ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ এ মহাসড়কে ঘটেছে। এর বাইরে অনেক ঘটনা ঘটে। কিন্তু কোনো ঘটনা গুরুতর না হলে সংবাদমাধ্যমে আসে না। ফলে এগুলো হিসাবের বাইরে থেকে যায়।
জানা গেছে, ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল, বরিশাল সিটি বাইপাস ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের ফোর লেন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ নকশা করা হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এ মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে একটি ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত মোট ১৯৫ কিলোমিটার চার লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে থাকবে আলাদা দুটি সার্ভিস লেন। সড়কটি হবে ১৭০ ফুট চওড়া। মোট ৩০৩ একর জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্পের জমি এখনও অধিগ্রহণ করা যায়নি। অথচ প্রকল্প প্রস্তাবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝি এসেও কাজ শুরু করতে পারেনি সড়ক ও সেতু বিভাগ।
জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের পরিচালক ও বরিশাল সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম আজাদ রহমান বলেন, ফরিদপুর-মাদারীপুর-বরিশাল-পটুয়াখালী জেলার ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কটির জমি অধিগ্রহণের জরিপ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণের মূল্য পরিশোধের ৪৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের কাছে বরাদ্দের টাকা পাঠানো হয়েছে। তারাই এসব জমি অধিগ্রহণ করবে। এরপর মূল সড়কের নির্মাণকাজ শুরু হবে।
তবে ঠিক কবে নাগাদ এই অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা যাবে, সে কথা জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি অর্থায়নকারীও খুঁজছে সওজ। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এ মহাসড়ক নির্মাণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়ন করার আগ্রহ দেখিয়েছিল, কিন্তু গত জুন মাসে মহাসড়ক পরিদর্শন করে তারা জানায়Ñ ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পটুয়াখালীর পায়রা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হবে। চার লেন করলে রেলের মতো পরিবেশবান্ধব বাহনে যাত্রী চাহিদা কমতে পারে।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর এ মহাসড়কে যানবাহন বেড়েছে কয়েকগুণ। এর উন্নয়ন আমাদের প্রথম প্রাধিকার। আর একটি বড় প্রকল্পও যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে সেটি হবে এই সড়ক। আমরা অর্থায়নকারী খুঁজছি। পেলেই কাজ শুরু করব। এডিবিকে রাজি করাতে চেষ্টা চলছে।’
সড়ক নিরাপদ করার দাবি সবার
বরিশাল বাসমালিক গ্রুপের সভাপতি আফতাব হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরে ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটাসহ দক্ষিণের ছয় জেলায় মহাসড়কের গাড়ি চলাচল ছয়গুণ বেড়েছে। আগে দুই থেকে আড়াইশ গাড়ি চললেও বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজারের অধিক। কিন্তু ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্ত করা হয়নি। তাই এ মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, অপ্রশস্ত সড়কে দুটি গাড়ি অতিক্রম করতে গিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটছে। এ ছাড়া এই রুটে নতুন নতুন বাস চলছে। এসব চালকের এ রুট সম্পর্কে ধারণাও খুব কম।
বিআরটিএর বিভাগীয় পরিচালক প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান জানান, বরিশালের বিভিন্ন আন্তঃজেলা রুটে চলাচলকারী বাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬০ ভাগেরই ফিটনেস নেই। গাড়িগুলো এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘটের ভয় রয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় না বিআরটিএ।
গৌরনদী হাইওয়ে থানার ওসি গোলাম রসুল মোল্লা মনে করেন, সড়কের প্রশস্ততা বাড়লে দুর্ঘটনা কমবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মাওয়া-ভাঙ্গা ৫৫ কিলোমিটার চকচকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে এসে যখন এ সড়কে পড়ে, তখন একই গতিতে চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারায় গাড়ি। তা ছাড়া পদ্মা সেতু চালুর পর এক ট্রিপের জায়গায় সবাই এখন দুই-তিন ট্রিপ দিতে চায়। তাই বেশি গতির কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়। দুটি বড় গাড়ির প্রশস্ততা প্রায় ১৮ ফুট আর মহাসড়কটি মাত্র ২৪ ফুট। গাড়িগুলো ছোট ছোট গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়েও দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।’
তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্য এই মহাসড়ক থেকে দ্রুত নসিমন-করিমন সরিয়ে মিনিবাসের স্বল্প দূরত্বের সেবা চালু করা উচিত।