আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩ ০৯:০২ এএম
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৫৯ পিএম
চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতুসংলগ্ন বাস্তুহারা এলাকার একটি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানায় কাজ করছেন হাছিনা বেগমসহ কয়েকজন নারী। ছবি- নিপুল কুমার
চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা এলাকার বাসিন্দা মো. কাদের। রাত হলে ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঘোরেন নগরীর অলিগলি। মানুষের ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনা হাতড়ে সেখান থেকে প্লাস্টিকের আবর্জনা খুঁজে বের করাই তার কাজ। রাতভর আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক খুঁজে সেগুলো সকালে বিক্রি করেন মহাজনের কাছে। কাদের জানান, এতে দৈনিক ৫০০ টাকার মতো আয় হয়।
কাদেরের মতো অনেকেই শহরের আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন। সব আবর্জনা জড়ো করা হয় পতেঙ্গার আনন্দবাজার ডিপোতে। প্রতিদিন সেখানে ময়লা নিয়ে গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির পিছু পিছু ছুটতে দেখা যায় স্থানীয় এক দল মানুষকে। গাড়ি থেকে ময়লা ফেলতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে কার আগে কে বেশি প্লাস্টিক বোতল কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে পারবে।
কুড়ানো এসব প্লাস্টিক বর্জ্য মহাজনের হাত ঘুরে চলে যায় নগরীর প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানাগুলোতে। চট্টগ্রাম শহরে দুই ধরনের প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি দেখা যায়। এর মধ্যে এক ধরনের রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি শুধু প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে। সেগুলো রিসাইক্লিং করে প্লাস্টিক ফ্ল্যাস্ক বিদেশে রপ্তানি করে তারা। আরেক ধরনের রিসাইক্লিং ফ্যাক্টরি সব ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে। এরপর গ্রেড কালার আলাদা করে সেগুলো রিসাইক্লিং করে ফ্ল্যাস্কগুলো পাঠিয়ে দেয় রাজধানীর ইসলামবাগে। দেশীয় প্লাস্টিক কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত হয় এসব ফ্ল্যাস্ক।
চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার একটি রিসাইক্লিং কারখানা সুমাইয়া প্লাস্টিক। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে রাখা প্লাস্টিকের স্তূপ থেকে ধরন ও রঙ অনুযায়ী আলাদা করে রাখার কাজ করছেন কয়েকজন। সেসব প্লাস্টিক মেশিনে ভেঙে গুঁড়ো করা হচ্ছে একপাশে। কারখানার পরিচালক মো. রাসেল জানান, তার কারখানায় মোট ২০ জন লোক কাজ করেন। তিনি পাইকারি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো ফ্ল্যাস্ক বানিয়ে ইসলামবাগে বিক্রি করেন। বাছাই, চূর্ণ করার পর ধুয়ে শুকিয়ে এগুলোকে বিক্রি করার উপযোগী করতে হয়। গড়ে ৪০ টাকা কেজি দরে প্লাস্টিক কেনার পর এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরও ১৫ টাকার মতো খরচ হয়। তিনি ৬০ থেকে ৬৫ টাকার মধ্যে বিক্রি করেন। দৈনিক এক থেকে দেড় টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন তিনি। রাসেল জানান, শহরজুড়ে এমন সাড়ে তিনশ প্রতিষ্ঠান আছে।
সুমাইয়া প্লাস্টিকের পাশেই ইমন এন্টারপ্রাইজ। সেখানে রিসাইক্লিং করা প্লাস্টিক ফ্ল্যাস্ক বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সেখানে দেখা যায়, স্তূপ করে রাখা প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েকজন নারী লেভেল ছাড়িয়ে রঙ ভেদে আলাদা আলাদা বস্তায় রাখছেন। তাদের একজন জোসনা দেবনাথ। কুমিল্লার নবীনগর থানার এই বাসিন্দা ছেলে আর ছেলের বউয়ের সঙ্গে থাকেন বাস্তুহারা এলাকায়। তার স্বামী থাকেন নবীনগরে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি জানান, এক বস্তা পূর্ণ করলে ৫০ টাকা পান। দিনে তিন-চার বস্তা পূর্ণ করতে পারেন। নিজের ওষুধের খরচ উঠে যায় এতে।
৪০ জনের মতো শ্রমিক এই কারখানায় কাজ করেন। কারখানার ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান জানান, চারটা মেশিনে ফ্ল্যাস্ক তৈরির কাজ হয়। ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করেন তারা। আগে চীন ও ভারতে এসব ফ্ল্যাস্ক রপ্তানি করলেও এখন দুটি দেশই ফ্ল্যাস্ক সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে তুরস্কের মাধ্যমে আমেরিকা তাদের একমাত্র বাজার। এক সময় মাসে ৬০০ টনের মতো বর্জ্য রপ্তানি করলেও বর্তমানে ৪০০ টনে নেমে এসেছে। প্রতি টন রপ্তানি করে ৭০০ ডলারের মতো আয় হয়। সেই হিসাবে এই একটি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক রপ্তানি আয় ৩ কোটি টাকার মতো। চট্টগ্রাম শহরে এমন প্রতিষ্ঠান আছে আরও চারটি।
কারখানা মালিকরা জানান, এসব কারখানা চালাতে তাদের পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও শিল্পকারখানা অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হয়।