জলাবদ্ধতা
আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেনী
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৪৯ এএম
আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৬:২৬ পিএম
জলাবদ্ধ রাস্তায় এভাবেই প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতে হয় বাসিন্দাদের। প্রবা ফটো
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চর মজলিশপুর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাপলাসি খালের দেড় কিলোমিটারজুড়ে ইটের বাঁধ এবং খালের জায়গা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করায় বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশন। সামান্য বৃষ্টিতেই খালটির আশপাশের বাড়িগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে গ্রামটির শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে থাকে।
রবিবার (২৭ আগস্ট) গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেক পরিবারের আঙিনায় ও রান্নাঘরে পানি। কোমরপানি ভেঙে তাদের চলাচল করতে হচ্ছে। কেউ বসতঘরে রান্না বসিয়েছেন। শুকনা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে। পানির চাপে চলাচলের রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি ভেঙে চলাচল করায় অনেকেই ঠান্ডাজনিত ও চর্মরোগে ভোগেন। রাতে সাপের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হন না।
গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মজলিশপুর গ্রামটি নিচু আর আশপাশের এলাকা উঁচু হওয়ায় ৩০ বছর আগে গ্রামের পানি নিষ্কাশনের জন্য ছোট ফেনী নদীর সঙ্গে সংযোগ করে স্থানীয়দের কাছ থেকে জায়গা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে একটি খাল কাটা হয়। ২০ বছর আগে মাছ শিকারের জন্য খালটিতে একটি ইটের বাঁধসহ আরও কয়েকটি বাঁধ দেওয়া শুরু হয়। এ ছাড়া খালের পাশের বাসিন্দারা খাল ঘেঁষে বাড়ি নির্মাণ করায় তখন থেকেই জলাবদ্ধতার শুরু। বৃষ্টি হলেই গ্রামের একটি অংশ থেকে পানি বের হতে পারে না। সর্বশেষ গত চার মাস পানিবন্দি রয়েছে ওই গ্রামের জেলেপাড়ার শতাধিক পরিবার।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় ২০ বছর ধরে বর্ষাকালে এমন দুর্ভোগের মধ্যে থাকলেও কেউ এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেননি। যারা খালে বাঁধ দেন, তাদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এমনকি তাদের নামও বলতে চান না কেউ।
জসিম উদ্দিন নামের একজন বলেন, বর্তমানে জলাবদ্ধতায় তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা জমিতে ফসল করতে পারছেন না। পুকুরের মাছও ভেসে যাচ্ছে। এবার আমনের মৌসুম চলে যাচ্ছে। এখনও ধানের চারা লাগাতে পারেননি।
গ্রামের বাসিন্দা রুহি চন্দ্র দাস বলেন, মাছ শিকার করা, অন্যের পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে দেওয়া তাদের প্রধান পেশা। তাদের গ্রামটি নিচু হওয়ায় এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় উঁচু জায়গা থেকে পানি এসে জমে থাকে। চার মাস ধরে তারা জলাবদ্ধতায় ভুগছেন। বাড়ি থেকে বের হতে হলে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি ডিঙিয়ে বাজারে বা কাজে যেতে হয়। বর্ষা মনে হচ্ছে তাদের জন্য অভিশাপ। জলাবদ্ধতার কারণে বিশেষ করে বর্ষাকালে তাদের বিয়েশাদি ও ধর্মীয় অনেক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়।
বৃদ্ধ সুমিতা রানী দাস বলেন, খালে যারা বাঁধ দিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই এ এলাকায় বাস করেন না। তাদের বাড়ি পার্শ্ববর্তী এলাকায়। মাছ চাষ করার জন্য তারা প্রথমে খালের পাশের জমিতে বাঁধ দেন। পরে খালেও বাঁধ দেওয়া শুরু করেন। এতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় জেলেদেরকে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
তুষার চন্দ্র দাস নামে এক স্কুলছাত্র বলে, প্রতিটি বইখাতা, প্যান্ট ও জামা একটি ব্যাগে ভরে তা মাথায় নিয়ে হাফ প্যান্ট পরে কোমরপানি ভেঙে মূল সড়কে ওঠে। পরে সেখানে ভেজা কাপড় খুলে শুকনো জামা ও প্যান্ট পরে স্কুলে যায়। বিকালে ফেরার পর আবারও একই কায়দায় বাড়িতে যায়। বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে তাকে কয়েকজন মিলে কাঁধে করে হাসপাতালে নিতে হয়। তাদের এই দুর্দশা দেখার কেউ নেই।
দিপালী রানী দাস নামে একজন বলেন, তার আঙিনা ও রান্নাঘরে পানি উঠেছে। এ অবস্থায় বাড়িতে থাকা কঠিন। তিনি সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেরি করে প্রতিবেশীর বাড়িতে যান। সারা দিন বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরেফিরে সময় কাটান। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। তখন বসতঘরে চুলা পেতে কোনোরকমে রান্না করেন। এভাবে চার মাস ধরে জীবনযাপন করছেন।
কামাল উদ্দিন বলেন, জমে থাকা পানিতে পা দিলে খুব চুলকায়। পায়ের আঙুলে ক্ষত হয়।
জানতে চাইলে চর মজলিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এমএ হোসেন বলেন, মজলিশপুর গ্রামের জলাবদ্ধতার সমস্যাটি জেনে শুক্রবার সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।