আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেনী
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৪১ এএম
ফেনীর সোনাগাজীতে চর আব্দুল্লাহয় ভেড়ার পাল নিয়ে আসেন খামারিরা। প্রবা ফটো
ফেনীর সোনাগাজীতে চরাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমি দখল নিতে বিষ প্রয়োগে গত এক সপ্তাহে ৫০০ ভেড়া হত্যার অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী একটি চক্রের বিরুদ্ধে। উপজেলার চর আবদুল্লাহ বিটের প্রায় বিশ হাজার একর বনবিভাগের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে চক্রটির বিরুদ্ধে। যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
এদিকে বনবিভাগ একাধিক মামলা করেও ভূমিগুলো উদ্ধার করতে পারেনি। জানা যায়, প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত এসব জায়গা দখল করে মাছ চাষ করছে। খামারিরা ভেড়ার পাল নিয়ে চরে গেলে এসব পুকুরে পানি পান করে থাকে। আর এই সুযোগে বর্তমানে পুকুরে মাছ না থাকায় পানিতে বিষ দিয়ে রাখলে উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব চর চান্দিয়া ও চর আবদুল্লাহ এলাকায় ১০ জন খামারির পাঁচ শতাধিক ভেড়া মারা যায় বলে অভিযোগ করেন তারা। এতে এক কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তাদের।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, খামারিরা যেন আর চরে না আসেন, সেজন্য এ রকম ঘৃণ্য কাজ করে থাকতে পারে চক্রটি। আর এতে তাদের চর দখল আরও নির্বিঘ্ন হবে। তারা ভেড়া নিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েছেন। এমনকি ভয়ে মামলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মামলা করা হয়েছে।
খামারি ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে শতাধিক ভেড়ার খামারি রয়েছেন। একেক খামারি একশ-এক হাজারেরও বেশি ভেড়া রয়েছে। চরাঞ্চলে প্রাকৃতিক খাবার, নোনা ও মিঠাপানি পান করে বেঁচে থাকে ভেড়াগুলো।
এক সপ্তাহ ধরে হঠাৎ করে বিভিন্ন খামারে অসুস্থ হয়ে খামারে ও মাঠে ঘাস খাওয়া অবস্থায় ভেড়া মারা যাচ্ছে। ভেড়া মারা যাওয়ার ঘটনায় খামারিরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিষয়টি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নেবু লাল দাসকে জানালে তিনি সরেজমিনে গিয়ে ভেড়াগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মারা যাওয়ার কারণ উদঘাটনের চেষ্টা করেন। পরে একটি মৃত ভেড়াকে ফেনীর আঞ্চলিক পশু হাসপাতালে নিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তে দেখায় যায়, ভেড়াগুলো খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব চর চান্দিয়া এলাকার খামারি মো. নাজমুল হাসান বলেন, তার খামারে চার শতাধিক ভেড়া রয়েছে। চরে জবরদখল করা একটি মৎস্য খামারের পানি খেয়ে ভেড়াগুলো হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গত এক সপ্তাহে তার খামারের প্রায় ২০০ ভেড়া মারা গেছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে জানালে তিনি সরেজমিনে ভেড়াগুলোকে পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেন। কিন্তু কোনোভাবে ভেড়া মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। পরে তার পরামর্শে একটি মৃত ভেড়াকে ফেনী পশু হাসপাতালে নিয়ে ময়নাতদন্ত করে দেখা যায় প্রতিটি ভেড়া বিষাক্ত কোনো খাবার বা পানি খেয়েছে। এতে করে বিষক্রিয়ায় ভেড়াগুলো মারা যাচ্ছে। এরপর থেকে এক সপ্তাহ ধরে সুস্থ ও অসুস্থ ভেড়াগুলোকে খামার থেকে বের না করে খামারে রেখেই পরিচর্যাসহ খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।
এ ছাড়া একই এলাকার খামারি ফকির আহম্মদের ৯০টি, মো. হানিফের ৮৫টি, আবুল কাশেমের ৪৫টি, মো. রফিকের ৫০টি, হেদায়েত উল্যাহর ৫টি, মোবারক হোসেনের ৮টি, ওয়াজি উল্যাহর ৮টি, মো. নোমানের ৬টি, আবুল হাসেমের ৭টিসহ ১০ জন খামারির পাঁচ শতাধিক ভেড়া বিষক্রিয়ায় মারা গেছে।
খামারি মো. রফিক বলেন, দক্ষিণ চর চান্দিয়া এলাকার খামারে তার দুই শতাধিক ভেড়া রয়েছে। ওই এলাকায় অন্তত ১০-১২ জনের খামারের ভেড়ার সঙ্গে তার ভেড়াগুলোও চরে একসঙ্গে ঘাস খায়। গত চার দিন আগে হঠাৎ করে ভেড়া মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসে খামারে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন তার শতাধিক ভেড়া অসুস্থ হয়ে খাবার ছেড়ে দিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে।
তার খামারের লোকজন তাকে জানান, চরে মৎস্য প্রকল্পগুলোর পানি পান করার পর থেকে ভেড়াগুলো হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেছে। এরপর থেকে অনেকগুলো ভেড়া মারা যায়।
তিনি বলেন, যে খামারের পানি খেয়ে ভেড়া মারা গেছে সেই মৎস্য খামারটি অবৈধভাবে খাসজমি দখল করে স্থানীয় মো. লিটন, ফরিদ হোসেন, আবুল হাসেম ও হক সাহাব নামে চারজন গড়ে তুলেছেন।
ফকির আহম্মদ বলেন, তাদের ভেড়াগুলো প্রতিদিন ওই প্রকল্পে পানি খেতে যায়। তাদের ধারণা প্রকল্পে মাছ না থাকায় অবৈধ দখলদাররা পানিতে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। এতে করে পানি খাওয়ার পর ভেড়াগুলো মারা যাচ্ছে। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও সাড়া দেননি অভিযুক্তরা।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নেবু লাল দাস ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ভেড়া মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব চর চান্দিয়া এলাকার খামারে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে ভেড়াগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোভাবে এর হদিস পাচ্ছিলেন না। পরে তিনি মারা যাওয়া কয়েকটি ভেড়াকে ফেনীর আঞ্চলিক পশু হাসপাতালে নিয়ে ময়নাতদন্ত করেন। ময়নাতদন্তের বিস্তারিত প্রতিবেদনে মারা যাওয়া ভেড়ার মধ্যে বিষক্রিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। মূলত চরে বিষাক্ত কোনো খাবার বা পানি খেয়ে ভেড়াগুলো মারা গেছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। আপতত সুস্থ ও অসুস্থ ভেড়াগুলোকে চিকিৎসা দিয়ে কয়েক দিন খামারে রেখে পরিচর্যা ও খাবার খাওয়াতে খামারিদের পরামর্শ দিয়েছেন।
উপজেলা বন কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, বনবিভাগের ভূমি উদ্ধারে সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দশটির অধিক মামলা করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কেউ কেউ কারাগারে আছেন, কেউ কেউ জামিনে আছেন। এর আগে ভূমিদস্যুদের হাতে বনবিভাগের লোকজন একাধিকবার হামলার শিকারও হয়েছিলেন।
সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। খাসজমি উদ্ধারে শিগগিরই সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।