শরিফুল ইসলাম, নড়াইল
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৮ পিএম
আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৯:৪৯ পিএম
তনিমা আফরিন। প্রবা ফটো
স্কুলে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায় তনিমা আফরিনের। কষ্ট করে এইচএসসি পাসের পর আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। সংসারজীবনে অধিকাংশ সময়ই কেটেছে স্বামীর কর্মস্থলে। স্বামী নাজমুল হক সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বছর তিনেক আগে অবসরে গেছেন। স্বামীর বিভিন্ন জায়গার কর্মস্থলে তনিমা গড়ে তুলেছিলেন বেলকনি বাগান। বর্তমানে নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন বিশাল আকৃতির ছাদবাগান। নড়াইলের সবচেয়ে ভালো মানের বড় ছাদবাগানের মালিক এই গৃহিণী। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এই শখের বাগান থেকে প্রতিবছর ইনকাম করছেন লক্ষাধিক টাকা।
‘শখ থেকেই মূলত সেই বাগান করা শুরু। সেখান থেকে নেশা। আর এখন পেশা। বাগান থেকে আয় করতে হবে, পুরস্কার পেতে হবেÑ এই চিন্তা কখনোই মাথায় ছিল না। অথচ অল্প সময়ে মিলেছে জাতীয় পুরস্কার।’
এই বাগানমালিক তনিমাকে দেখে নড়াইল শহরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় শতাধিক ছাদবাগান। তনিমা ইতোমধ্যে নড়াইলের ছাদবাগান মালিকদের মডেল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
শহরের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের খেলার মাঠের দক্ষিণ দিকে রাস্তার পাশে চারতলা ভবন। এই বাড়িটি তনিমা আফরিনের। তিনতলায় স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন জাতীয় কৃষি পুরস্কার পাওয়া এই বাগানমালিক তনিমা। এই বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন বাগান। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন তনিমা আফরিন। কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ওইদিন ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই পুরস্কার বিতরণীতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, বাগানমালিক তনিমার মা তহমিনা হুসাইন ছিলেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। শিশুকাল থেকে মাকে দেখেছেন বাড়িতে নানা ফল ও ফুলের গাছ লাগাতে। অফিস থেকে এসে পরিচর্যা করতেন। এই পরিবেশে বড় হয়ে ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় তার। নড়াইল শহরে বাড়ি করার পর ২০১৬ সালে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তনিমা। স্বামীর কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসার সময়ে ৩৮টি টবে করে গাছ নিয়ে এসেছিলেন। সেই টব দিয়ে তখন থেকে শুরু করেন ছাদে বাগান করা। অল্প অল্প করে গড়ে তুলেছেন বিশাল আকৃতির এই বাগান।
বাগান সমৃদ্ধ করতে দেশের নামকরা নার্সারিগুলোতে গিয়েছেন তনিমা। গিয়েছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছাদবাগান দেখতে। সেখান থেকে ট্রেনে করে, বাসে করে অনেক কষ্টে জোগাড় করা ওই ছাদবাগানের চারাগুলো। বর্তমানে ছাদবাগান-সংক্রান্ত চারটি ফেসবুক গ্রুপ চালান তনিমা। যুক্ত আছেন এ-সংক্রান্ত অর্ধশতাধিক ফেসবুক গ্রুপে। এর মাধ্যমে চারা সংগ্রহ করেন, পরিচর্যা শেখেন, অন্যদের পরামর্শ দেন। বিভিন্ন জেলায় চারা বাজারজাতকরণও তার ফেসবুকের মাধ্যমেই। ফেসবুকে তার শুধু গাছের সঙ্গে মিতালি।
সরেজমিন তনিমা আফরিনের ছাদবাগানে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের গাছ প্রজাতি অনুযায়ী সারি সারি সাজানো। লোহার পাত দিয়ে র্যাক তৈরি করে, তার ওপর রাখা অধিকাংশ টব। সরাসরি ছাদের ওপরও রাখা আছে অনেক টব। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে পাকা করে করা হয়েছে হাউস। সেখানে মাটি দিয়ে লাগানো হয়েছে গাছ। প্রতিটি সারির মাঝে আছে গলিপথ। গলিপথ ও গাছগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নেই কোনো ময়লা-আবর্জনা। এমনভাবে গাছগুলো সাজানো, সব গাছে পড়ছে রোদ। প্রতিটি গাছের পাশে যাচ্ছে দাঁড়ানো। সবুজের সমারোহ আলতো বাতাসে দোল খাচ্ছে, সে এক অন্যরকম নয়নাভিরাম দৃশ্য।
দেশের নানা জায়গা থেকে জোগাড় করেছেন হরেক রকম ফুলগাছ। তার ছাদে গোলাপই আছে ৪৫ প্রকার। ২০ প্রকার জবা ফুল, ৮ প্রকার কাঁটগোলাপ, ৫ প্রকার শাপলা, ১০ প্রকার রেইন লিলি। আছে ২৫ প্রকার অর্কিড। এ ছাড়া সারি সারি শোভা পাচ্ছে অ্যাডেনিয়াম, রঙন, বেলি, মাধবীলতা, পানচাটিয়া, হাসনাহেনা, নন্দিনী, মালঞ্চ, পদ্ম, কাঁটামুকুট, জার্বেরা, রজনীগন্ধা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়া, গজানিয়া, পেঞ্জি, ক্যালুন্ডেলা, ভারবেরা ও স্কটসহ দেশি-বিদেশি হরেক প্রজাতির ফুলগাছ।
ফলগাছেও ভরপুর তার ছাদ। আছে বারোমাসি ও মৌসুমি ফল। একই ফলের আছে টক ও মিষ্টি প্রজাতি এবং নানা রঙের। আছে আপেল, আঙ্গুর, মাল্টা, কমলা, কদবেল, ছফেদা, রয়েল, জামরুল, বাতাবি লেবু, কাগুজে লেবু, বেদানা, আম, তেঁতুল, ড্রাগন, কলা, লিচু, লংগন, পিসফল, আমড়া, পেয়ারা, শরুফল, কাউফল ও আখসহ আরও ফল।
সজিনা, পুঁইশাক, বেগুন, উচ্ছে, কলমিশাক, সবুজশাক, লালশাক, ডাঁটা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, টমেটো, সিম, লাউ, কুমড়া, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, শালগম, মুলা, পেঁয়াজ ও মরিচসহ নানা সবজির আবাদ করেছেন ছাদে। নিম, তুলসী, ননীফল ও অ্যালোভেরার মতো ঔষধি গাছও আছে। আছে ঘর ও বেলকনি সাজানোর মানিপ্ল্যান্ট, স্নেকপ্ল্যান্ট, পাতাবাহর, বেবিটিয়ারস, কইলাস ও স্পাইডারপ্ল্যান্ট। চায়না বটগাছ, দেশি বটগাছ, পাকড় ও জেডপ্লান্টের মতো বনসাই গাছ শোভা পাচ্ছে তার ছাদে।
ছাদবাগানের মালিক তনিমা আফরিন বলেন, শুরুতে যখন সংসার খরচের টাকা দিতেন স্বামী। সেখান থেকে বাঁচাতাম। পাঁচ কেজি মাংসের জায়গায় দুই কেজি কিনেছি। ন্যূনতম দামের প্রয়োজনীয় কাপড় ছাড়া দামি কাপড় কিনিনি। এভাবে সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে গড়ে তোলা শখের এই বাগান। গত তিন বছর হলো চারা তৈরি করে বিক্রি করছি। এতে খরচ ওঠে, সংসার চলে। এছাড়া সংসারের প্রয়োজনীয় সবজি ও ফল তেমনটি কেনা লাগে না, বাগান থেকে উৎপাদন হয়। প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের সবজি ও ফল দিই। আবার গাছের চারা বিক্রি করে বছরে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয়।
নিজের একক আন্তরিকতায়ই গড়ে উঠেছে এই সমৃদ্ধ ছাদবাগান জানিয়ে তনিমা আফরিন বলেন, প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা ব্যয় করি ছাদে। প্রতিদিনই পানি দিতে হয়। ঘাস পরিষ্কার করতে হয়। পোকা লাগল কি না তা দেখা। কোনটার কী খাবার লাগবে, কখন লাগবে। এগুলো বুঝে চলতে হবে। তাহলেই আসবে সাফল্য।
নড়াইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রোকনুজ্জামান বলেন, তনিমা আফরিন একজন গৃহিণী হয়েও তার একক প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির ফুল, ফল ও নানা জাতের গাছ সংগ্রহ করেছেন। তা পরিচর্যা করে সফল হয়েছেন। ছাদে এত ধরনের ফসল আবাদ করা যায় তার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তনিমা আফরিন। দিন দিন জেলায় ছাদবাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানান তিনি।